শিরোনাম: |
বস্ত্রশিল্পের সম্ভাবনা
|
মীর আব্দুল আলীম : বাংলাদেশের বস্ত্রখাতে বৃহত্তম তিনটি উপখাত স্পিনিং, উইভিং ও ড্রাইং-ফিনিশিং। এই উপখাতগুলোয় প্রায় ৫৫ লাখ কর্মকতা-কর্মচারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। দেশের বৃহত্তর বিনিয়োগ এ খাতে, তাই এ খাতে যেমন সমস্যা তেমন সম্ভাবনাও প্রচুর। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ খাতকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সহায়ক বাজেট প্রয়োজন। তৈরি পোশাক শিল্পের সহযোগী শিল্প হিসেবে এ তিনটি খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, যার কারণে তৈরি পোশাক শিল্পখাত ৭৬ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। আজকের প্রবন্ধে আমরা বাংলাদেশের বৃহত্তম শিল্পখাত তথা বস্ত্রখাত সম্পর্কে আগামী বাজেটে কী থাকা উচিত আর কী থাকা উচিত নয়, তা নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করার চেষ্টা করব।
ব্যাংক ঋণের অপ্রতুলতা, অর্থাভাব, উচ্চ সুদের হার, বাড়তি কর ভ্যাটের বোঝা আর গ্যাস বিদ্যুত্ সঙ্কটে বিপর্যস্ত এ খাতকে দেশের স্বার্থেই বাঁচানে দাবি অনেকেরই। সবারই জানা দেশীয় টেক্সটাইল খাত ধ্বংসের গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আন্তর্জাতিক চালে আটকে যাচ্ছে এ শিল্প। গত কয়েক বছরে অসংখ্য টেক্সটাইল মিল (তাঁত) বন্ধ হয়ে গেছে। আমার নিজ এলাকা শিল্প সমৃদ্ধ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে এ শিল্পের অনেকে লোকসান গুনতে গুনতে পথে বসেছেন। এমন চিত্র সারাদেশের। সরকারি সুতা এবং বস্ত্রকল ধ্বংস হয়ে গেছে। বেসরকারি সুতাকলগুলোর অবস্থা কিছুটা ভালো ছিল। বস্ত্র শিল্পের উত্পাদিত কাপড়ের দাম উত্পাদন খরচ থেকেও কমে যাওয়ায় লোকসান দিচ্ছে বস্ত্র কলগুলো। যার প্রচণ্ড প্রভাব পড়েছে ডাইং প্রিন্টিং শল্পে। বস্ত্র (তাঁত) এবং ডাইং শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় স্পিনিং (সুতা কল) শিল্প বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সুতা কলগুলোও। যেগুলো চলছে তা চলছে অনেকটাই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। এদিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে মিল মালিকরা এখন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে ব্যস্ত। বেশি দামে আমদানিকৃত তুলা দিয়ে সুতা ও কাপড় তৈরি করে মিল মালিকরা এখন চোখে অন্ধকার দেখছেন। ক্রেতার অভাবে তাদের গুদামে দীর্ঘদিন ধরে জমে আছে লাখ লাখ টন সুতা। এভাবে মাসের পর মাস লোকসান দিয়ে এবং ব্যাংকের ঋণ ও সুদ গুনতে গিয়েই বন্ধ হয়ে গেছে শতাধিক স্পিনিং ও টেক্সটাইল মিল। আর দেশীয় সুতা ও বস্ত্র কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তৈরি পোশাক শিল্পেও পড়তে শুরু করেছে নেতিবাচক প্রভাব। দেশের বস্ত্র ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর দাবি, তারা নানাভাবে ৩৫ শতাংশ রাজস্ব দিচ্ছে সরকারকে। এ হারে রাজস্ব দিয়ে শিল্পায়ন হবে না বলে ব্যবসায়িক নেতারা অর্থমন্ত্রীকে সম্প্রতি প্রাক বাজেট আলোচনায় সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। তারা বলেছেন, দেশের মাত্র ১০ শতাংশ ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান মূল্য সংযোজন কর মূসক বা ভ্যাট দেন। বাকি ৯০ শতাংশ দেন না। তাই পরিধি বাড়িয়ে ভ্যাটের হার কমিয়ে সারাদেশ থেকে ভ্যাট আদায়ে ব্যবসায়ীরা প্রস্তাব করেন। ভ্যাটের হার নয় পরিধি বারানোর ব্যবসায়ীদের প্রস্তাব যুক্তিযুক্ত মনে হয়। হাল সালের তথ্য মতে, দেশে ভ্যাট নিবন্ধন আছে ৮ লাখ ৪০ হাজারের। কিন্তু মাত্র ৩২ হাজার ব্যবসায়ী ভ্যাট দেন। এটা খুব কম। এটাকে বাড়াতে হবে। এদিকে ভ্যাট আইন নিয়ে ভীতিতে আছেন ব্যবসায়ীরা। এরই মধ্যে রাজস্ব কর্মকর্তাদের কাছ থেকে হয়রানির হুমকি পাচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা। নতুন আইনে কোনো হয়রানির সুযোগ থাকবে না আশ্বস্ত করে রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান বলেছেন, যে কোনো অভিযোগ সরাসরি তার দফতরে জানাতে পারবেন ব্যবসায়ীরা। রাজস্ব বোর্ডের প্রাক বাজেট আলোচনায় এসব কথা উঠে এসেছে। যতদূর জানি, জুলাইয়ের এক তারিখ থেকে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হবেই। এই সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছে রাজস্ব বোর্ড ও অর্থমন্ত্রণালয়। ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, নতুন পদ্ধতিতে ভ্যাট দেয়া কিংবা হিসাব নিকাশ করার মতো সামর্থ্য ও প্রস্তুতি ছোট ব্যবসায়ীদের নেই। তাই নতুন আইন নিয়ে তারা শঙ্কিত। অল্প সময়ে তারা সবকিছু গুছিয়ে উঠতে পারবেন কি-না তাতে সন্দেহ আছে। এছাড়া দেশের বস্ত্র শিল্পের যা অবস্থা তাতে ছোটখাটো বস্ত্রশিল্পই বেশি সমস্যায় পড়বে। ভ্যাট আয়কর আর মূসকের চাপে তারা এখন ব্যবসাই টিকিয়ে রাখতে পারছেন না তার উপর দক্ষ জনবল বাড়ানো তাদের জন্য কষ্ট সাধ্য হবে। বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় আনা উচিত্ মনে করি। বস্ত্র শিল্পকে বাঁচাতে ২০১৭-১৮ সালের বাজেটে বস্ত্র খাতের উপর বিশেষ নজরদারি প্রয়োজন। টেক্সটাইল খাতে বিনিয়োগ উত্সাহিত করার স্বার্থে কর অবকাশ সুবিধা আগামী ২০২০ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি করা অত্যাবশ্যক। গ্লোবালাইজেশন, সুতার মূল্যবৃদ্ধি, ইউ রুলস অব অরিজিনসহ অন্যান্য কারণে সৃষ্ট অসম প্রতিযোগিতা মোকাবিলার মাধ্যমে ওভেন উপখাতকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে বিকল্প নগদ সহায়তা ৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ন্যূনতম ১৫ শতাংশ নির্ধারণ এবং তা আগামী ২০২০ সাল পর্যন্ত অব্যাহত রাখার প্রস্তাব দিয়েছে বিটিএমএ। এর ফলে বস্ত্রখাত উপকৃত হয়ে অর্থনীতিতে আরও অবদান রাখতে সক্ষম হবে মনে করছে সংগঠনটি। এটি তাদের যৌক্তিক দাবিও। বস্ত্রশিল্পে ব্যবহূত যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ, সাইজিং ম্যাটেরিয়েল, রাসায়নিক দ্রব্যে শুল্ক ও কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা দরকার। বর্তমানে বিদ্যমান শতাংশ আমদানি শুল্ক উদ্যোক্তাদের আর্থিক বোঝা লাঘবের ক্ষেত্রে তেমন কোনো ভূমিকা রাখছে না। তাই বস্ত্রশিল্পে বিনিয়োগ উত্সাহিত ও প্রকল্প ব্যয় হ্রাসকরণের স্বার্থে আগের মতো বস্ত্রখাতে ব্যবহূত যাবতীয় ক্যাপিটাল মেশিনারিকে শূন্য শুল্কে আমদানির সুবিধা দেয়া প্রয়োজন। স্পিনিং শিল্পের জন্য দেশে বর্তমানে চার মিলিয়ন বেলের বেশি তুলা আমদানি করা হয়। মিল কর্তৃক তুলা আমদানি হলে কোনো ধরনের শুল্ক ও কর দিতে হয় না। কিন্তু দেশের বাজার থেকে অন্য কোনো মাধ্যম থেকে তুলা কিনলে প্রতি পাউন্ডে ২ দশমিক ২৫ টাকা হারে ভ্যাট দিতে হয়। ফলে সুতার উত্পাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাজেটে এই ভ্যাট প্রত্যাহার করা জরুরি। বর্তমানে বস্ত্র কারখানায় ব্যবহার অযোগ্য তুলা, যা বর্জ্য হিসেবে পরিচিত, তা মিল থেকে অপসারণ করতে প্রতি কেজিতে এক থেকে ১০ টাকা হারে ভ্যাট দিতে হয়। যদিও এই বর্জ্য তুলা কোনো উত্পাদনে ব্যয় হচ্ছে না; বরং বিদ্যমান আইনে বর্জ্য অপসারণের ক্ষেত্রে নানা জটিলতা, অনিয়ম ও হয়রানির সৃষ্টি হচ্ছে। এসব দিক বিবেচনায় আগামী বাজেটে বর্জ্য তুলা অপসারণে ভ্যাট প্রত্যাহার করা দরকার। যেসব কারখানা পরিবেশ দূষণ করতে পারে বিশেষ করে বস্ত্রখাতের ড্রাইং-ফিনিশিং খাতের জন্য ইটিপি স্থাপন বাধ্যতামূলক। কারণ শিল্প-কারখানা এসব বর্জ্য পদার্থ ও দূষিত পানি পরিবেশকে নষ্ট করে এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ইটিপি স্থাপন বেশ ব্যয়বহুল, যার পরিকল্পনা ব্যয়ও অনেক। তাই ছোটখাটো শিল্প প্রতিষ্ঠান ইটিপি স্থাপন করতে পারে না। অন্যদিকে ইটিপি স্থাপনের পর যে কেমিক্যাল প্রতিদিন ব্যবহূত হয় এর ফলে শিল্পকারখানার জন্য উত্পাদন খরচ বাড়ে। শিল্প কারখানায় ইটিপিতে যে কেমিক্যাল ব্যবহূত হয়, তার আমদানি ও মূল্য সংযোজন কর যথাক্রমে ১২ শতাংশ ও ১৫ শতাংশ। এই দুটি কেমিক্যালের আমদানি ও মূল্য সংযোজন কর প্রত্যাহার করলে ইটিপি স্থাপনের ব্যয় হ্রাস পাবে। তাতে ব্যবসায়ীরা ইটিপি স্থাপন ও পরিচালনা নিয়মিত করবেন। এ ক্ষেত্রে যে দুটি কেমিক্যালের অগ্রিম আয়করের বিধান রয়েছে, তা অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহার করা উচিত। আমাদের দেশে পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে শিল্পাঞ্চলে সরকারিভাবে ইটিপি স্থাপন করা যেতে পারে। যারা ইটিপি ব্যবহার করবেন তারা সরকারকে একটি নির্দিষ্ট হারে অর্থ প্রদান করবেন। তাতে করে সকল শিল্পকারখানা ইটিপির আওতায় আসবে, পরিবেশ বাঁচবে, শিল্পকারখানাগুলোও হয়রানি থেকে রক্ষা পাবে। অনেক ডাইং মালিক দীর্ঘদিন লোকসান গুনতে গুনতে পথে বসেছেন। চালু শিল্পকারখানাগুলো চলছে অতি কষ্টে। শ্রমিকদের বেতন জোগাড় হয়তো গ্যাস, বিদ্যুত্ বিল বকেয়া পরে থাকে। এই হচ্ছে অবস্থা। এমন অবস্থায় কোটি টাকা ব্যয় করে ইটিপি স্থাপন সম্ভব হয় না। তাছাড়া ছোটখাটো ডাইং শিল্পের ক্ষেত্র শিল্পের সমপরিমাণ টাকা ইটিপিতে ব্যয় অসাধ্য হয় মালিকদের জন্য। এ বাজেটে ডাইং শিল্প সমৃদ্ধ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ, ফতুল্লা, সাভার, নরসিংদী, মাধবদীতে সরকারিভাবে ইটিপি স্থাপন করা গেলে শিল্প যেমন বাঁচবে। পরিবেশও দূষণের হাত থেকে রক্ষা পাবে। এ জন্য আগামী বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখার কথা সরকার ভাবতে পারে। চলতি বাজেটে বস্ত্র খাতকে বাঁচাতে এ শিল্পের জন্য আয়কর হার কমানোর ব্যবস্থা করা, বিকল্প নগদ সহায়তার উপর ধার্যকৃত কর প্রত্যাহার করা, বিকল্প নগদ সহায়তা ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করা, পুরাতন মূলধনী যন্ত্রপাতিকে পিএসআই’র (প্রাক জাহাজিকরণ পরিদর্শন) আওতার বাইরে রাখা, বস্ত্রশিল্পে ব্যবহূত যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ, সাইজিং ম্যাটেরিয়াল ও রঙ রসায়নের শুল্ক ও কর প্রত্যাহার করা, অ্যাক্রেলিক টপসের উপর শুল্ক ও কর প্রত্যাহার করা, পলিয়েস্টার, স্ট্যাপল ফাইবারের এইচএস কোড (পণ্য পরিচিতি কোড) সংশোধন করা অত্যাবশ্যক। বর্তমানে বস্ত্র উত্পাদনের সঙ্গে জড়িত সুতার মিল, সুতা ডায়িং, ফিনিশিং, কাপড় তৈরি, কাপড় ডায়িং, ফিনিশিং এবং প্রিন্টিংয়ের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠান থেকে অর্জিত আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে আয় কর দিচ্ছে। যদিও তৈরি পোশাকশিল্পের উেস আয়কর হার হচ্ছে ০.৪০ শতাংশ এবং পোলট্রি খাতে আয়কর হার ৫ শতাংশ। আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে বিকল্প নগদ সহায়তার ওপর ৩৭.৫০ শতাংশ আরোপিত কর সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। তা প্রত্যাহার করা জরুরি। প্রাথমিক টেক্সটাইল খাতে একটি কার্যকর ‘ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প’ গড়ে তোলার জন্য সরকার ৫ শতাংশ নগদ সহায়তা দেয়। কিন্তু এ থেকে সরকার প্রায় ৩৭.৫০ শতাংশ কর হিসেবে কেটে নেয়। ফলে যে উদ্দেশে ব্যবসায়ীদের এ সহায়তা দেয়া হয় তা সত্যিকারের কাজে লাগে না। ব্যবসায়ীরা দাবি করেন, এসব সহায়তা নিট আয় হিসেবে না দেখে আয়করমুক্ত হিসেবে আগামী বাজেট থেকে কার্যকর করতে। দেশের চলমান বিদ্যুত্ সমস্যা সমাধানে আমদানিকৃত জেনারেটরের যন্ত্রাংশ রেয়াতি শুল্কে খালাসের সুবিধা প্রয়োজন। বস্ত্র খাতে জেনারেটরের মাধ্যমে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুত্ উত্পাদনের ব্যবস্থা রয়েছে। স্পিনিং মিলগুলো ২৪ ঘণ্টা চলে। তাই ক্যাপটিভ পাওয়ার জেনারেটর হিসেবে এসব জেনারেটরের জন্য স্পেয়ার পার্টস আমদানি করতে হয়, যন্ত্রাংশের আমদানি শুল্ক বর্তমানে প্রায় ২৬.৪৬ শতাংশ। এ মাত্রাতিরিক্ত হারে আমদানি শুল্ক ও কর প্রদানের কারণে উত্পাদন খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই আসন্ন বাজেটে যাবতীয় মেশিনারিজ বিনাশুল্কে আমদানি করার বিধান করা প্রয়োজন। বৈধ-অবৈধ পথে বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ কম দামের ভিনদেশি সুতা প্রবেশ করায় দেশীয় সুতার কারখানাগুলো অসম প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। কারণ বাংলাদেশের সুতা কারখানার মালিকদের সার্ভিস চার্জ ও চক্রবৃদ্ধিসহ ব্যাংক ঋণের সুদের হার গুণতে হয় ২২ থেকে ২৩ শতাংশ পর্যন্ত। আবার সরকারের পক্ষ থেকে এ খাতের জন্য কোনো ধরনের প্রণোদনা দেয়া হয় না। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তুলাও কিনতে হয় চড়া দামে। তুলা ক্রয় বিক্রয়েও ঢুকে পড়েছে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা। এ দেশীয় ঐতিহ্যবাহী সুতা ও বস্ত্রশিল্প ধ্বংসের ষড়যন্ত্র যুগ যুগ ধরেই চলছে। আজও থেমে নেই। এ কথা কোনো রাখঢাক না রেখেই বলা যায়, ভারত বাংলাদেশের সুতা ও বস্ত্র খাতের বাজার পুরোপুরি দখল করে রাখতে সুকৌশলে অনেকগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। একদিকে তারা এ খাতকে দিচ্ছে আকর্ষণীয় প্রণোদনা (ইনসেনটিভ) সুবিধা, অন্যদিকে ব্যাংক ঋণের সুদের হারও রেখেছে সর্বনিম্ন। ফলে ভারতীয় সুতা কলগুলোর উত্পাদন খরচ বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম পড়ছে। কেজিপ্রতি তারা ৫ ডলার থেকে ৫ ডলার ২০ সেন্টস দরে বিক্রি করছে। আর নানা বৈধ-অবৈধ পথে বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণে এই কম দামের সুতা প্রবেশ করায় দেশীয় সুতার কারখানাগুলো অসম প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। কারণ বাংলাদেশের সুতা কারখানার মালিকদের সার্ভিস চার্জ ও চক্রবৃদ্ধিসহ ব্যাংক ঋণের সুদের হার গুনতে হয় ২২ থেকে ২৩ শতাংশ পর্যন্ত। আবার সরকারের পক্ষ থেকে এ খাতের জন্য কোনো প্রকারের প্রণোদনা দেয়া হয় না। ফলে সব মিলিয়ে দেশীয় মিলগুলোর অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার পথে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কয়েক বছর ধরে তৈরি পোশাকের জন্য জিএসপির নতুন যে শর্ত দিয়েছে, তাতে স্পিনিং ও টেক্সটাইল শিল্পখাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমদানি ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে বিদেশি সুতা ও বস্ত্রের। পাশাপাশি দেশীয় সুতার বাজারে ভারতীয় আগ্রাসনে বিপর্যস্ত দেশীয় স্পিনিং শিল্প। এ দিকে ইইউতে জিএসপির নতুন শর্তে ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রিফারেন্স (জিএসপি) সুবিধার শর্ত পরিবর্তন করেছে। এর ফলে বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশের স্পিনিংসহ টেক্সটাইল খাতের উদ্যোক্তারা। এতদিন ইউরোপীয় ইউনিয়নে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশের পোশাক রফতানিকারকরা দেশে উত্পাদিত কাপড় ও সুতা ব্যবহার করতো। তাদের সুতার চাহিদার বেশিরভাগই পূরণ করত দেশীয় স্পিনিং মিলগুলো। কিন্তু জিএসপির শর্ত পরিবর্তন করায় এখন বিদেশ থেকে সুতা ও কাপড় আমদানি করে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। শুধু সেলাই করেই পোশাক ইউরোপে শুল্কমুক্তভাবে রফতানি করতে পারছে তারা। বিষয়টি নিয়ে চলতি বাজেটে ভাববার দরকার রয়েছে। পোশাক প্রস্তুতকারকরা কাপড় ও সুতা ব্যাপকভাবে আমদানি করছে। ইতোমধ্যেই বিদেশি সুতা ও কাপড়ে ছেয়ে গেছে বাংলাদেশ। ফলে ভয়াবহ সঙ্কটের মধ্যে পড়েছে দেশের সুতা তৈরির মিলগুলো। সুতার আমদানি বেড়ে যাওয়ায় দেশে বিপুল পরিমাণ সুতা অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। মিল মালিকরা বাধ্য হয়েই উত্পাদন খরচের চেয়ে কম দামে স্টক লটের সুতা বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। বেশির ভাগ স্পিনিং মিল মালিক উচ্চমূল্যে তুলা রফতানি করে, উচ্চ সুদে ব্যাংক ঋণ নিয়ে সুতা তৈরি করে বসে আছেন, কিন্তু ক্রেতা পাচ্ছে না। ফলে চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে সুতার মিল মালিকদের। তাদের হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ভেস্তে যাচ্ছে। চোখে সরষে ফুল দেখছেন তারা। অথচ দেশের ৮০ শতাংশ কাপড়ের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি করছে আমাদের দেশের তাঁত শিল্প। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে তাঁতিসমাজে মানবিক বিপর্যয় দেখা দেবে। শ্রমিকদের বেকার হওয়ার বিষয়টি যেমন অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিতে হবে, তেমনি তাঁত শিল্প বাঁচানোর উদ্যোগও নিতে হবে। দেউলিয়া হওয়ার আগে চলতি বাজেটে প্রণোদনার ব্যবস্থা না করলে তাঁত শিল্প ও শ্রমিক বাঁচানো সম্ভব হবে না। দেশের বস্ত্রখাতে বিদ্যমান সঙ্কট সমাধানের উপায় হচ্ছে, স্পিনিং মিলগুলোর জন্য অন্তত ২০ শতাংশ হারে ক্যাশ ইনসেনটিভ প্রদান ও গোটা বস্ত্রখাতের জন্য ব্যাংক ঋণের সুদের হার সর্বোচ্চ ৭ থেকে ৮ শতাংশে নিয়ে আসা। ডাইং শিল্পের জন্য সরকারিভাবে (যৌথ) ইটিপি স্থাপন করা, দেশীয় সুতা ও কাপড় প্রস্তুতকারকদের ১৫-২০ শতাংশ হারে ক্যাশ ইনসেনটিভ দেয়া। এছাড়া বাহিরের বস্ত্র এবং সুতা আমদানিতে যথাযথ তদারকি করা। বস্ত্রশিল্পকে বাঁচাতে হলে এই উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি বিদ্যুত্-গ্যাস সঙ্কটেরও সমাধান করা জরুরি। আমাদের শিল্প সংরক্ষণ নীতি গ্রহণের সাথে সাথে শিল্প-আগ্রাসনও প্রতিরোধ করতে হবে। এ ব্যাপারে জাতীয় স্বার্থকে গুরুত্ব না দিলে দেশের বস্ত্রশিল্প বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হবে। লেখক: কলাম লেখক |