মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
শিশুশ্রম বন্ধে চাই সম্মিলিত প্রচেষ্টা
Published : Thursday, 25 May, 2017 at 6:00 AM, Count : 984

মো. ওসমান গনি : আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত্। এ স্লোগানকে সামনে রেখে শিশুকে ভবিষ্যতের জন্য সু-নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। একজন শিশুকে সু-নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে আমাদের শিশুকে বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শিশুরা যাতে হেসে-খেলে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে, দেশের প্রতিটা অভিভাবককে সে ব্যবস্থা করতে হবে। শিশুকে শিশুর মতো করে বেড়ে ওঠার সুযোগ দিতে হবে। শিশুদের কাজ হলো লেখাপড়া করা আর খেলাধুলা করা। কিন্তু আমাদের দেশে শিশুদের লেখাপড়া বাদ দিয়ে অনেক অভিভাবক তাদের সাংসারিক কাজে লাগান। এমনকি অনেক জায়গায় দেখা যায়, শিশুদের শ্রম বিক্রি করে অভিভাবকরা টাকা রোজগার করেন। যার কারণে শিশুদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তার শারীরিক বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে রোগক্রান্ত হয়ে এক সময়ে সে অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। শিশুশ্রম আমাদের দেশে একটা বড় সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানের জন্য আজও আমাদের দেশে কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। শিশুশ্রম বন্ধের জন্য আমাদের দেশে আইন আছে কিন্তু আইনের কোনো সঠিক প্রয়োগ না থাকার কারণে দেশে শিশুশ্রমের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
আমাদের একটা কথা স্মরণ রাখতে হবে, শিশুরা শ্রমের হাতিয়ার নয়, জাতির ভবিষ্যত্; শিশুদের হাতে ভিক্ষার থলে নয়, চাই বই ও কলম- এ কথাণ্ডলো আজ শুধুই বইয়ের পাতায় লিপিবদ্ধ। তারা আজ বিভিন্ন কাজে শ্রম বিক্রি করেও প্রকৃত মজুরি থেকে বঞ্চিত। শিশুদের অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে আসছে। বিদ্যালয়ে না গিয়ে জীবিকা নির্বাহের কাজ করছে। অল্প বয়সেই অভাব অনটনে বাধ্য হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে তারা। যে বয়সে তাদের স্কুলে গিয়ে হাসি-আনন্দে বেড়ে ওঠার কথা, সে বয়স থেকে ধরতে হচ্ছে তাদের অভাবি সংসারের হাল। দেশের বিভিন্ন স্থানে ভাসমান অধিকাংশ শিশু অভিভাবকের কাজে সহযোগিতা করা ছাড়াও মোটর, রিকশা ও সাইকেল নির্মাণের কাজ, বিদ্যুত্, ইটভাটা, চা দোকান, হোটেল, রেস্টুরেন্টে কাজ, রাজমিস্ত্রির সাহায্যকারী, ওয়েলডিং কারখানায়, গার্মেন্ট, জুটমিল, কৃষিসহ বিভিন্ন কাজ করে থাকে।
এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার ফলে ওদের শারীরিক গঠন বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। অনেক সময় মারাত্মক দুর্ঘটনাও ঘটে। আবার তারা অনেক সময় পঙ্গুও হয়ে থাকে। এদের মধ্যে বেশির ভাগ শিশু শ্রমিকের বয়স ৫ থেকে ১৪-১৫ বছর। এরা সারাদিন কাজ করে দিনের শেষে ১৫ থেকে ৫০-৬০ টাকা কিংবা মাস শেষে ৫০০-৬০০ টাকা পেয়ে থাকে। যা তাদের শ্রম এবং প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। আমাদের দেশে এক শ্রেণির সুযোগসন্ধানী লোক রয়েছে যারা শিশুশ্রম সস্তা হওয়ায় তাদের প্রতিষ্ঠানে শিশুদেরকে শ্রমিক হিসাবে নিয়োগ দিয়ে থাকে কাজ করার জন্য। আমাদের দেশে প্রতিদিনই নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে রাজধানীসহ সারাদেশে বিভিন্ন স্থানে কর্মরত শিশু শ্রমিকরা। অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে অকালে প্রাণও হারাচ্ছে অনেক শিশু। দেশে এ বিষয়ে আইন থাকলেও তাদের দরিদ্র্যতা, অশিক্ষা তথা পরিবারের দুর্বলতা এবং ঘটনা গোপন থাকায় অনেক সময়ই বিচার হয় না।কর্মরত শিশু, শিশুশ্রম, ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের আলাদা সংজ্ঞা রয়েছে। ১৮তম শ্রম পরিসংখ্যানবিদদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এবং ২০১৩ এর সংশোধন অনুসারে কর্মরত শিশু বলতে বোঝায়- ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে যারা সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টা পর্যন্ত হালকা পরিশ্রম বা ঝুঁকিহীন কাজ করে। এ শ্রম অনুমোদনযোগ্য। তবে ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশু যদি কোনো ধরনের ঝুঁকিহীন কাজও করে, তবে সেটা শিশুশ্রম হবে। আর ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী কেউ যদি সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টার বেশি কাজ করে, সেটা ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম হিসেবে স্বীকৃত। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী প্রায় ৭.৪ মিলিয়ন শিশু কর্মে নিয়োজিত। এর মধ্যে ৪.৭ মিলিয়ন শিশুর বয়স ৫ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে এবং ১.৩ মিলিয়ন শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে জড়িত। শিশুশ্রম বন্ধে প্রকৃত সমাধান বের করতে হবে। পরিবারের কর্মক্ষম অভিভাবকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে, শিশুদের ফ্রি চিকিত্সা ও লেখাপড়ার সব খরচ বহন অর্থাত্ প্রতিটি পরিবারের কর্মক্ষম সদস্যদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ছাড়াও শিশুদের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সরকারি বরাদ্দের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা যদি পথশিশুসহ কর্মরত শিশুদের কল্যাণে প্রাথমিক পযার্য়ে কারিগরি ও কৃষি শিক্ষা প্রদান করতে পারে এসব শিশু অল্প মজুরিতে শ্রম বিক্রি না করে স্বাবলম্বী হতে পারবে। ওদের কারিগরি ও কৃষি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারলে মানবসম্পদে পরিণত করা সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে শহরের বস্তিসহ গ্রামে কারিগরি শিক্ষা প্রদানে সর্বপ্রকার অনিয়ম দূর করতে হবে। শিশু শিক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের কোনো প্রকার অপচয় কঠোর হাতে দমন করতে হবে। এ ব্যাপারে জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন।
সরকার প্রতিটি শিশুর মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। ২০২১ সালের মধ্যে দেশ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন হবে  আশা করা যায়। আর ২০২৫ সালের মধ্যে নিরসন হবে সব ধরনের শিশুশ্রম। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায়  ২০২৫ সালের মধ্যে দেশ থেকে সব ধরনের শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্যমাত্রা নিধার্রণ করা হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সম্মিলিত উদ্যোগ এবং যথাযথ বাজেট বরাদ্দ করা হলে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব। শিশু অধিকার সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। তেমনি দারিদ্র্য দূরীকরণে আরও মনযোগী হতে হবে। সবাই মিলে শিশুদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হলে একটি সুন্দর দেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন সফল হবে। দেশ ও জাতি উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে পারবে এবং শিশুশ্রমের অভিশাপ থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হবে।আমাদের দেশে শিশুশ্রম বন্ধের যে আইন আছে তার সঠিক প্রয়োগ করলে এবং শিশুশ্রম বন্ধের জন্য ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালালে দেশের শিশুশ্রমের পরিমাণ অনেকটা কমে আসবে বলে দেশের বিজ্ঞমহল মনে করেন। তাছাড়া যে সব মেইল, ফ্যাক্টরি এবং ব্যক্তিবর্গ শিশুদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে থাকে তাদের ব্যাপারে আইনগত কঠোর ব্যবস্থা নিলে ও শিশুশ্রম অনেকটা হ্রাস পেতে পারে। আইন করে আমাদের দেশের শিশুদের শ্রম বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে দেশের সব অভিভাবকদের তাদের সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য শিশুশ্রম বন্ধ করে তাদের লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। শিশুরা লেখাপড়া শিখে সঠিক মানুষ হিসেবে গড়ে উঠলে তারা দেশের জাতীয় সম্পদে পরিণত হবে। শিশুদের অভিভাবকদের সারা জীবনের পরিশ্রম কিছুটা হলে ও সার্থক হবে। তাই আমাদের দেশের শিশুশ্রম বন্ধের জন্য আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকা লাগবে। স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমেও সরকারের আইন প্রয়োগ করে শিশুশ্রম বন্ধ করা যেতে পারে। দেশের প্রতিটি এলাকায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্কুলের সময় ছাত্রছাত্রীদের খুঁজে বের করে আনতে হবে। এলাকার শিশুদের অভিভাবকদের নিয়ে স্থানীয়ভাবে মেম্বার, চেয়ারম্যান, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে শিশুশ্রম বন্ধের জন্য সভা-সমাবেশ করা যেতে পারে।

লেখক: কলাম লেখক



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : [email protected], [email protected]
Developed & Maintainance by i2soft