শিরোনাম: |
খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করছে ব্যাংকগুলো
|
বর্তমান প্রতিবেদক : বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা থাকলেও আর্থিক অবস্থা ভালো দেখাতে খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করছে দেশের ব্যাংকগুলো। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পাশাপাশি অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংকও খেলাপি ঋণের আসল চিত্র আড়াল করছে। এছাড়া প্রয়োজনের তুলনায় সঞ্চিতি (ভবিষ্যতে কোনো সমস্যায় ব্যবহারের উদ্দেশ্যে লাভের অংশ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা রাখা) কম রেখেই মুনাফাও দেখিয়েছে বেশ কয়েকটি ব্যাংক। এসব কারণে ব্যাংকগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তাদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তৈরি করা প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত তিন মাসে খেলাপি বেড়েছে ১১ হাজার ২৩৭ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে এর পরিমাণ ছিল ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ৬ বাণিজ্যিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি, ৩৫ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে ছিল ৩১ হাজার ২৫ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর প্রান্তিকে চার হাজার ৭১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র আড়াল করে চালাকির আশ্রয় নিয়েছিলো রাষ্ট্রায়ত্ব চার ব্যাংক। এর মধ্যে জনতা ব্যাংক এক হাজার ৭৭১ কোটি, অগ্রণী ৯২৭ কোটি, রূপালী ৬৯১ কোটি ও সোনালী ব্যাংক ৬৮২ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ গোপন করে। খেলাপি ঋণ নীতিমালা অনুযায়ী, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঋণ ফেরত না দিলে ওই ঋণ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা নিয়ে যে সব খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ পায়, সেই ঋণগুলোকে তখন আর খেলাপি বলার সুযোগ থাকে না। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংক চালাকির আশ্রয় নিয়ে খেলাপি হয়ে যাওয়া ঋণ পুনঃতফসিল করে নিয়মিত হিসাব করেছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওই ঋণগুলোর বিষয়ে তদন্ত করে দেখেছে, ওই ঋণ ফেরত পাবে না ব্যাংক। প্রসঙ্গত, কয়েক বছর আগের রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে অনেক ব্যবসায়ী একই ঋণ একাধিকবার পুনঃতফসিল করে নিয়েছেন। ঋণ শ্রেণিকরণ নীতিমালা অনুসারে কোনো ঋণ তিন থেকে ছয় মাসের কম সময় পর্যন্ত মেয়াদোত্তীর্ণ থাকলে সেটি নিম্নমান বা সাব-স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে শ্রেণিকৃত হবে। ছয় থেকে নয় মাসের কম সময় পর্যন্ত মেয়াদোত্তীর্ণ থাকলে শ্রেণিকৃত হবে সন্দেহজনক বা ডাউটফুল হিসেবে। আর নয় মাসের বেশি সময় মেয়াদোত্তীর্ণ থাকলে গণ্য হবে মন্দ বা ব্যাড/লস হিসেবে। এদিকে, থেকেই খেলাপি ঋণ নিয়ে কোনো চালাকির আশ্রয় না নিতে সরকারি চার ব্যাংকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনে এক প্রার্থীর খেলাপি ঋণের বিষয়ে চতুরতার আশ্রয় নেয়ার কারণে জনতা ব্যাংককে কারণ দর্শানো নোটিশ পাঠিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বলেন, ‘খলাপি ঋণের তথ্য গোপন করাটা মোটেও ভালো নয়। তবে সব ক্ষেত্রে চালাকি বলা যাবে না। কারণ, ঋণের গুণগত মান অনুযায়ী ব্যাংক যেটাকে নিয়মিত বলছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক হয়ত সেটাকে খেলাপি বলছে। তিনি আরও বলেন, যদি কোনো ব্যাংক বছরের পর বছর আদায় না হওয়া ঋণকে নিয়মিত বলে তবে সেটা হবে চতুরতা। ডিসেম্বর প্রান্তিকে সরকারি চারটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু অসঙ্গতি পেয়েছে। ব্যাংকগুলো যাতে খেলাপি ঋণ গোপন না করে, সে বিষয়েও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সূত্রমতে, বছরের শেষ দিকে সব ব্যাংকই নিজেদের মুনাফা প্রবৃদ্ধিসহ আর্থিক স্বাস্থ্য ভালো দেখাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো কিছু ঋণ পুনঃতফসিল করে। আবার কোনো ব্যাংক তথ্য গোপন করে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কম দেখায়। এদিকে, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ৩৬ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৪ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে উপস্থাপন করে জনতা ব্যাংক। কিন্তু জনতা ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা পরিদর্শন করে আরও এক হাজার ৭৭১ কোটি খেলাপি ঋণ খুঁজে পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। রূপালী ব্যাংক দুই হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ দেখালেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি পেয়েছে তিন হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংক তাদের দেয়া হিসেবে ১০ হাজার ২২৯ কোটি খেলাপি ঋণ দেখিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক পরিদর্শন করে আরও ৬৮২ কোটি টাকা বেশি পেয়েছে। এর বাইরে খেলাপি ঋণের মান অনুযায়ী সঞ্চিতিতে ব্যর্থ হওয়ার পরও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিশেষ সুবিধা নিয়ে বেশ কয়েকটি ব্যাংক মুনাফা বাড়িয়ে দেখিয়েছে। আবার কোনো কোনো ব্যাংক লোকসান কম দেখিয়েছে। এ প্রসঙ্গে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, কোনো কোনো ব্যাংক কিছু ক্ষেত্রে খেলাপি ঋণের বিষয়ে চালাকি করছে, এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কেউ ইচ্ছেকৃতভাবে খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করলে সেটাও চালাকি বলেই গণ্য হবে। তবে পুনঃতফসিল সংক্রান্ত জটিলতায় খেলাপি ঋণ অনেক সময় নিয়মিত ঋণে রূপ নেয়। এ ধরনের অসঙ্গতির প্রবণতাকে চতুরতা বলা ঠিক হবে না। |