শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪ ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
অদ্ভুতুড়ে
Published : Thursday, 27 April, 2017 at 6:00 AM, Count : 1017

ড. সাহানা বেগম : সে ছিল ঘন ঘোর বর্ষার সময়। সারাদিন বৃষ্টি হচ্ছে ঝরঝর, ঝরঝর। ‘কাঁপে পাতা পত্তর’। কয়েক মুহূর্তের জন্য যদি বা কমল তাও তা পড়তে থাকল টিপ টিপ, টিপ টিপ। আকাশ তার  সুরমা কালো মেঘের পর্দাখানি নিয়ে পৃথিবীর কাছাকাছি নেমে এসেছে, একেবারে কাছে।
এত বৃষ্টি কদিন ধরে একটানা, সঙ্গে দমকা বাতাস আর বিজলির খেলা চলছে যে প্রাত্যহিক কাজকর্ম গোল্লায় যেতে বসেছে। আমাদের এবং আর সবার স্কুল থেকে ছুটি ঘোষণা করেছে। স্কুল বন্ধ কি মজা! পড়া নেই কি মজা! কিন্তু সে আর কদিন। প্রথম কদিন ঘরের ভেতরে খেলাধূলো বেশ লাগল। স্কুল লাইব্রেরি থেকে আনা রহস্য বইগুলো পড়লাম কাঁথামুড়ি দিয়ে। ঘন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, সূর্য বিহীন মৃদু আলো, ক্ষণে ক্ষণে কড় কড়াত্ বাজের আওয়াজ এমন দিনেই তো রহস্য গল্প জমে ভালো।
এক সময় বইগুলোও শেষ হলো, খেলনাগুলো নিয়ে খেলাও শেষ হলো, কিন্তু বৃষ্টির ঝম ঝমিয়ে পানি পড়ার যেন কোন শেষ নেই। আমাদের বাড়িটি কাঠের তৈরি, লোকে বলে জাহাজ-বাড়ি। উঁচু উঁচু, মোটা মোটা কাঠের পায়ার উপর ঘরখানি বসানো। পায়ার আশপাশে তলাটা ফাঁকা। কুকুর, বিড়ালের দিনের বেলা, অনেক সময় রাতের বেলাতেও নিরুপদ্রপ ঘুমানোর জায়গা।
তিনখানি কাঠের সিঁড়ি বেয়ে, দরজা পেরিয়ে তবে নিচ তলায় ঢোকা যায়। নিচ তলার মেঝেয় কাঠের পাটাতন দেয়া। নিচ তলায় মা রাঁধা-বাড়া করেন। আমাদের খাওয়া দাওয়া, পড়াশোনা সবই নিচ তলায়। পাটি পেতে, কখনও বা মোছা মেঝে খানির উপর বালিশ নিয়ে দিনের বেলা আমরা ঘুমুই। ছোট শহর, বাড়ি ঘর এমনিতেই অনেক ফাঁকা ফাঁকা। দোতলা তিনতলা বাড়িঘর কিছু দেখা যায় বটে তবে বেশির ভাগই টিনের একচালা দোচালা আর আছে আরও কিছু বেড়ার দেয়ালের ছোটছোট বাড়িঘর। সারা শহর খুঁজলে এমন জাহাজ বাড়ি একটি কি দুটি দেখতে পাওয়া যায়। আমার বাবা কিভাবে যে এমন অদ্ভূত সুন্দর একটি বাড়ির সন্ধান পেলেন!
খুব গর্বের ব্যাপার আমার জন্য, বন্ধু-বান্ধবরা মাঝে মাঝেই এমন অদ্ভূত বাড়িটি দেখতে আসে। তাদের সবার চোখে একটা ঈর্ষা খেলা করে বেশ বুঝতে পারি। তখন মনে মনে বাবার এই বিশেষ বাড়িটি পছন্দ করাকে তারিফ করি। আমার বেশ অহংকার হয়, নিজেকে কেউ কেটা একজন ভাবতে ভালো লাগে।
আমার ছোট আর একটি ভাই ও বোন আছে। ভাইটি তো যেন পথ ভোলা এক দেবদূত, ভুল করে আমাদের ছোট্ট কাঠের বাড়িটায় আশ্রয় নিয়েছে। কি মায়াময় মধুমাখা তার কথাবার্তা, আর কি চমত্কার মন কাড়া নিষ্পাপ হাসি। নীলাভ সাদায় তিমির কালো পুতলীর, জল টলটলে সদা-অবাক দুটি চোখ। আমাকে ডাকে ‘দাম্মা’ বলে। ওর ‘দাম্মা’ ডাকে আমি হই দিশেহারা।
কিন্তু আজ কি হলো? আমি অবাক হচ্ছি ওর আচরণে। খানিক আগে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকল, ‘দাম্মা, আমার ফাই ইনি্জ, আমার ফাই ইনি্জ। এনে দাও, এনে দাও।
ওর জন্য আমি প্রাণ পাত করতে পারি এমনই ভালোবাসি আমি ওকে। বোনটাকেও কি আমি কম ভালোবাসী! আমি যেন ভালোবাসতে আর ভালোবাসা পেতেই জন্মেছি। ভালোবাসায় ভরপুর এক স্বর্গ আমাদের এই জাহাজ বাড়ি। কত সকালে ঘুম ভেঙে দোতলার মেঝের লম্বা ফাটা দিয়ে বাবা-মাকে পরস্পরের হাতে হাত নিয়ে চা খেতে দেখেছি। অথবা দেখেছি নির্ণিমেষে পরস্পরের দিকে অপলক চেয়ে থাকতে।
আমার ছোট ছয় মাস বয়সের বোনটি আমায় দেখলেই অবোধ্য ভাষায় ‘তাতা’, ‘তাতি’ নানান শব্দ করে দুহাত তোলে কোলে ওঠার জন্যে। কোলে উঠে ঘাড়ে মাথা হেলিয়ে দিয়ে আরামে আহলাদে বিগলিত কুঁ কুঁ আওয়াজ করে। কিন্তু আজ কি হলো। পৃথিবী হঠাত্ এত এমন বদলে গেল কেন?
ফাই ইনিজ অর্থাত্ ফায়ার ইনজিন নামে খেলনাটির রহস্য উদঘাটনে ব্যাপৃত হলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছে তোমার ফায়ার ইনি্জনের? পড়ে গেছে নদীতে। নদীতে? অর্থাত্ পানিতে; অঝোর ধারার বৃষ্টির জমে থাকা পানিতে। দমকা বাতাস থেমেছে। কিন্তু বৃষ্টি পড়ছে সবিরাম। আমাদের জাহাজ বাড়ির নিচের তলাটা দেড় মানুষ সমান উঁচু পানিতে ডুবে গেছে।
একতলার ভেতর দিয়ে দোতলায় ওঠার যে সিঁড়িটা সেটা প্রায় তলিয়ে গেছে। বাবা সেদিন অফিস গেলেন নৌকায় করে। দুদিন তিনি আসেন না তার খবরের কাগজের অফিস থেকে; তিনি আসবেন না দু রাত, খুব নাকি কাজ পড়েছে। আশ্বাস দিয়ে গেছেন আগামী কাল বিকেলের মধ্যেই নাকি বৃষ্টি থেমে যাবে আর পানি নাকি দ্রুত নেমে যাবে।
বাবা এসব কি বলেন, আমি দেখছি আকাশ মাটির তৈরি পোড়া হাঁড়ির তলার মতো ঝুলে আছে পৃথিবীর ওপর! কি জানি হবেও বা। বাবা যে পত্রিকা অফিসে কাজ করেন, তারা যে আগাম সব কিছু জানতে পারে। মায়ের ভারী ভরষা বাবার ওপর।
আমি ঝাঁপিয়ে পানিতে পড়লাম। কিন্তু খেলনা কই? পানি যে আমার মাথার উপর দিয়ে বইছে। ভাগ্যিস সাঁতার জানি। আনাচে-কানাচে কোথাও নেই। প্রথমে মনে হয়েছিল বড় জাম্বুরা গাছের গুঁড়ির সঙ্গে আটকে ওটা হয়ত বা ভাসছে। না তা তো নয়। ভাইটার হাসিমুখ দেখতে চেয়েছিলাম, বীরত্ব দেখাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু না এবার উঠে পড়তে হবে। এটুকুতেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।
পানির একটা জোরালো টান অনুভব করছি খালের দিকে। এবার উঠব। সাঁতরে দোতলার বারান্দার কাছাকাছি গিয়ে উপরে রেলিং ধরে এক হ্যাঁচকা টানে উপরে উঠতে চাইলাম। বাদ সাধল ছোট ভাই।
কর্তৃত্বের সুরে সে বলল খুঁজে নিয়ে এস ফাই ইনি্জ, এখনই উঠছ কেন?’
চমকে ওর মুখের দিকে তাকালাম। এভাবে তো কখনও কথা বলে না। লক্ষ্য করলাম ওর চোখ দুটো জ্বলছে অঙ্গারের মতো। চেহারা হয়ে উঠেছে ভয়ঙ্কর, যদিও ওর আগেকার চেহারার আদলটুকু আছে। আমি আবারও উঠতে চেষ্টা করলাম। এবার আমার ভাই কোথা থেকে একটা লোহার রড এনে আমার আঁকড়ে ধরা হাতের আংগুলে আঘাত করল। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় হাত ছেড়ে দিয়ে আমি একটু তফাতে সরে আসি। এমন সময় মা এলেন ঝুল বারান্দায়। আমি তাকে সমস্যাটা জানালাম। মা একটা ক্রুর নিষ্ঠুর হাসি হেসে বললেন, ‘খেলনাটা নিয়ে তবেই উঠবি।
মা আমি যে আর সাঁতরাতে পারছি না। মা বলেন খেলনা নিয়ে তবেই উঠবি, আগে নয়।
মা ঘরের ভেতর চলে গেলেন। ভাবলাম এতদিন কোনো ভালোবাসার ছলনায় তাহলে ভুলেছিলাম।
আমি যাদের এত ভালোবাসি এরা তাহলে কারা? এরা কি তবে দূরাত্না, প্রেতাত্না। আর একবার রেলিংটা ধরে উঠতে চেষ্টা করলাম। নিমেষের ভেতর কোথা থেকে আমার অত প্রিয়ভাই একটা জ্বলন্ত চ্যালা কাঠ নিয়ে এসে আমার আংগুলে চেপে ধরল।
উঃ, মাগো বলে চীত্কার করে উঠে ডুবে যেতে থাকলাম। আমি শ্বাস নিতে পারছি না। একটু বাতাস আহ মাগো একটু বাতাস। খুব জোরে টেনে শ্বাস নিতে চাইলাম। দম বন্ধ হয়ে আসছে। এখুনি আমি মারা যাব..
..... এই তো শ্বাস নিতে পারছি। আমার চোখের দৃষ্টি আমার ঘরের ছাদে। বিছানায় ২০১৬ সালের নভেম্বর  মাসের ১৫ তারিখে আমি তবে স্বপ্ন দেখছিলাম। স্বপ্ন দেখছিলাম পঞ্চাশ দশকের পটভূমিকায়। আমাদের কোন জাহাজ বাড়িও ছিল না আর আমি দুই ভাইয়ের পর সর্বকনিষ্ঠ বোন। স্বপ্ন কত অদ্ভুতুড়ে হয়। আপনারা কি বলেন?



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : [email protected], [email protected]
Developed & Maintainance by i2soft