শুক্রবার ২৯ নভেম্বর ২০২৪ ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
শান্ত জলে শান্তির পরশ
ঢাকার একমাত্র দীঘি গঙ্গাসাগর
Published : Wednesday, 26 April, 2017 at 6:00 AM, Update: 26.04.2017 8:47:01 PM, Count : 945

বৈশাখ মাস তাতেই বৃষ্টির বাগড়া আর ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ঠ ঢাকা নগরীর জনজীবন এরই মাঝে যদি একটু শান্তির পরশ পাওয়া যেত তবে কেমন হতো? নিশ্চয়ই ভালো তাই না? আসলেই তাই জন্যই আজ হাওয়াবদলে রইল ঢাকার একমাত্র দীঘি গঙ্গাসাগর নিয়ে বিস্তর ফিচার লিখেছেন - অনিন্দ্য তাওহীদ
ঢাকায় আবার দীঘি? এমন প্রশ্ন অনেকের কাছেই হয়তো স্বাভাবিক। আবার অনেকেই কপালে ভাঁজ তুলে হয়তো বলবে, ঢাকায় অসংখ্য খাল, ডোবা, পুকুর থাকার কথা শুনেছি; কিন্তু দীঘি থাকার কথা এখনো শুনিনি।
তবে হ্যাঁ, ঢাকার অতি প্রাচীন একটি দীঘি আছে। দীঘিটির নাম গঙ্গাসাগর। বাসাবোর পূর্ব প্রান্তে রয়েছে দীঘিটি।
সবুজবাগ থানার অন্তর্গত রাজারবাগ মৌজায় এর অবস্থান। চমত্কার দৃষ্টিনন্দন আর ছায়াঘেরা বিশাল দীঘিটি দেখলে অনেকেরই চোখ ছানাভরা হয়ে উঠবে। তখন কেউ হয়তো বলবে এতদিন ঢাকায় থেকেও এই দীঘিটির সন্ধান পেলাম না? আগে জানলে বহুবার আসতাম দীঘির জলে শান্তির পরশ পেতে। কোলাহল এই নগরীর মাঝে এমন একটি দীঘিই সত্যিই বিনোদনের বাড়তি সুযোগ এনে দেবে নিশ্চয়ই। তাই সুযোগ হলে আজই ঘুরে আসতে পারেন এই ঐতিহাসিক দীঘি গঙ্গাসাগর দেখতে।
দিঘীর চারপাশ জুড়ে রয়েছে সরু হাটার জায়গা সঙ্গে রয়েছে অসংখ্য স্থাপনাও। যার মধ্যে দোকান, রিকশার গ্যারেজ আর পাকা-আধাপাকা ঘর-বাড়ি। বৃষ্টির দিনে দীঘিটি দেখতে আরও সুন্দর লাগে। টইটুম্বুর শান্ত জলে দখিনা বাতাসে হালকা ঠেউয়ের দোলানি আপনার মন রাঙিয়ে দেবে। আর এখানে গোসল করে নিজেকে শান্ত করে নিতে চাইলেও পারবেন।
শ্রী শ্রী বরদ্বেশরী কালীমাতা মন্দিরের ফটক পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হবে। চোখের সামনেই বিশাল এক দীঘি। নানা ধরনের গাছগাছালিতে আকীর্ণ দীঘিটির পূর্ব ও পশ্চিম পাড়ে আছে ছোট-বড় অনেক মন্দির। দীঘিটিতে অনেকেই গোসল করছে। আবার কেউ কেউ গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছে, ঘুমাচ্ছে।
স্থানীয়রা জানায়, প্রতিদিন অসংখ্য লোকজন ভ্রমণে আসেন এখানে। সকাল-সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত অব্দি মানুষের আনাগোনা লেগেই থাকে। ঢাকার মাঝে এমন একটি দীঘি থাকায় আশপাশের অনেকে প্রায়শই গোসল করতে আসেন।  কেউ কেউ আসেন পরিবার-পরিজন নিয়েও।
এ দীঘি নিয়ে আছে বহু কাহিনী, কিংবদন্তি। কথিত আছে মোগল সম্রাট আকবর ষোলো শতকের শেষের দিকে বাংলা বিজয়ের উদ্দেশে সেনাপতি মানসিংহকে এ এলাকায় পাঠান। রাজা মানসিংহ ঢাকা এসে এ এলাকায় তাবু ফেলেন এবং ঈশা খাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। তখন এ এলাকায় পানীয়জলের খুব অভাব ছিল। মানসিংহ তার সৈন্যসামন্ত দিয়ে বিরাট একটি দীঘি খনন করেন। নাম দেন গঙ্গাসাগর। এটি খনন হওয়ার পর এ এলাকার সাধারণ মানুষের পানীয়জলের সমস্যা দূর হয়। শুধু তাই নয়, দীঘিটি ক্রমেই হয়ে ওঠে তীর্থক্ষেত্র। ধর্মপ্রাণ মানুষ অষ্টমী স্নান, বারুণী স্নান উপলক্ষে এখানে এসে স্নানপর্ব শেষ করে পুণ্যি লাভের আশায়। তা ছাড়া প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে সনাতন ধর্মাবল্মীরা এসে এ দীঘিতে স্নান করে মনস্কামনা ব্যক্ত করেন। পরবর্তী সময়ে দীঘিটিকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয় বেশ কিছু মন্দির। এসব মন্দিরের মধ্যে আছে শ্রীশ্রী বরদেশ্বরী কালীমাতা মন্দির, শিব মন্দির, শীতলা মন্দির, বিশ্বকর্মা মন্দির, লোকনাথ মন্দির ইত্যাদি। দীঘির উত্তর-পশ্চিম কোণে রয়েছে একটি শ্মশান। যেখানে হিন্দুদের দাহ করা ছাড়াও বৌদ্যোদের কৃষ্টি সাধিত হয়।
দীঘিটির পরিমাপ প্রায় ৪ দশমিক ৫০ একর। উত্তর-দক্ষিণ লম্বালম্বি এ দীঘির তিনটি ঘাট ছিল। বর্তমানে দুটি ঘাট কোন রকম আছে,একটি উত্তর দিকে আর পূর্ব দিকে একটি। তবে দক্ষিন দিকের ঘাটটির অতিস্ত নাই বললেই চলে। সীমানা প্রাচীর রয়েছে তিন দিকে। পূর্ব দিকে কোনো প্রাচীর নেই। এখানে এক সময় ডোবা-নালা ছিল। এতে একটা সময় সারা বছর পানি থাকত এবং সেই পানি ছিল স্বচ্ছ ও সুপেয়। এখন অবশ্য নেই। দখল হয়ে গেছে পুরোটা। অসংখ্য ঘরবাড়ি উঠে গেছে সেখানটায়। স্থাপনার দৌরাত্ম্যে মৃতপ্রায় ডোবা-নালাগুলো।
যখন ওয়াসার পানি সরবরাহ বন্ধ থাকে তখন দক্ষিণগাঁও, নন্দীপাড়া, মানিকদী, বাসাবো, মাণ্ডা, মাদারটেক, গোড়ান প্রভৃতি এলাকার মানুষ এর পানি ব্যবহার করত। তারা রান্নাবান্না থেকে শুরু করে গৃহস্থালির সব কাজে এর পানি ব্যবহার করতো। এখন তা কেবলই স্মৃতি। স্থানীয়রা জানায়,দীঘিটিতে এর কোন ছাপ না পড়লেও দীঘির সৌর্ন্দয বিকাশে এর চারপাশ বেঁধে দেয়া প্রয়োজন। আর গ্যারেজ এবং যত্রতত্র স্থাপনাগুলো উঠিয়ে দিলে আরও সুন্দর লাগবে দীঘিটি। তখন ভ্রমণ পিপাসুরাও আরও  বেশি বিমোহিত হবেন।
দীঘিটি জীববৈচিত্র্যের অফুরন্ত আধার। এতে নানা ধরনের মাছ ছাড়া অন্যান্য জলজ প্রাণীও রয়েছে। আগে শীতকালে এখানে পরিযায়ী পাখি এসে আশ্রয় নিত। এখন আর দেখা যায় না। দীঘিটি স্থানীয়ভাবে বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। প্রতিদিন বিকেলে অসংখ্য মানুষ এসে এর পাড়ে বসে আড্ডা দেয়, গল্প-গুজব করে। এ জন্য এর পাশে কয়েকটি পাকা বেঞ্চ তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল। এগুলোর অবস্থাও ভঙ্গুর। দীঘির দক্ষিণ পাড়ে অসংখ্য রিকশা আর উত্তর পাড়ে বস্তি থাকায় সৌন্দর্যহানি হচ্ছে। তবে সংশ্লিষ্টরা চাইলে অনায়াশেই মন্দির ও দীঘিটিকে কেন্দ্র করে আরো আকর্ষণীয় বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তুলতে পারেন।
মোগল সেনাপতি মানসিংহের স্মৃতিবিজড়িত ৪০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন এ গঙ্গাসাগর ঢাকার একমাত্র দীঘি। প্রজাহিতৈষী মানসিংহ এ দীঘির মাধ্যমে স্মরণীয় হয়ে আছেন। দেবোত্তর সম্পত্তির অধীন এ দীঘির আশপাশের বেশ কিছু জমি এরই মধ্যে ভূমিদস্যুরা দখল করে নিয়েছে। খনন করার পর আজ পর্যন্ত এটি সংস্কার করা হয়নি। দীঘিটি সংস্কারের মাধ্যমে পাড় বাঁধাই করে একটি আকর্ষণীয় বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এলাকাবাসী দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছে।
মন্দির সভাপতি লায়ন চিত্তরঞ্জন দাস বলেন, উত্তর পাশে রিক্সার গেরেজগুলো উঠিয়ে দেবো শিঘ্রই আর চারপাশের সরু রাস্তা মেরামতের সিদ্ধান্ত মন্দির কমিটির রয়েছে। তবে অনুদান যথেষ্ট নয় ফলে একটু ব্যঘাত ঘটছে। তাছাড়া বাঙালির বারো মাসে তের পার্বন পালনেও অনেকে খরচের ব্যাপার থাকে যা অনেকটা নিজ উদ্যোগেই করছি। বৈশাখ মাসে বৈশাখী উত্সব-মেলা হয় এই দীঘির চারপাশজুড়েই। আবার দুর্গাপূজায় মাসব্যাপী মেলা হয় এখানে। আর দীঘির ও মন্দিরটিকে আরও বেশি ফোকাস করার জন্য সব সময়ই আমার প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে এবং থাকবে।
যেভাবে যাবেন: ঢাকার যে কোন প্রান্ত থেকে কমলাপুর বা এর একটু দক্ষিণ-উত্তরে অবস্থিত বৌদ্ধমন্দির। সেখান থেকে সোজা রিকশাযোগে বা অটোরিকশাযোগে চলে আসবেন রাজারবাগ বরদ্বেশরী কালীমাতা মন্দির গেট।
ভাড়া- রিকশায় ২০ টাকা আর অটোরিকশায় ১০ টাকা মাত্র। এই মন্দিরের মাঝেই সুবিশাল দীঘিটি।
লেখক: সাংবাদিক



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : [email protected], [email protected]
Developed & Maintainance by i2soft