শিরোনাম: |
প্রতিভা বিকাশের সুযোগ দিন
|
জি. কে. সাদিক : প্রত্যেক মানুষ জন্মগতভাবে অন্যের থেকে মেধা ও মননে, কর্মক্ষমতায়, চতুরতায়, ভিন্ন রুচিবোধ ও চিন্তাশক্তি নিয়ে জন্মায়। জন্মের পরবর্তী পরিবেশের আলোকে সে নিজেকে বিকশিত করে তুলে। আমরা মাঝে মাঝে স্টেশনগুলোতে, বাসটার্মিনালগুলোতে কিছু কিছু পথশিশুকে সুমিষ্ট সুরে গান করতে শুনি। তাদের গলার স্বর আমাদের অবাক করে তোলে। একটু লক্ষ্য করলেই আমার দেখব যে, এরা কিন্তু কারও কাছ থেকে গান শিখেনি, এদের নেই কোনো বাদ্যযন্ত্র, এমনকি হয়ত গান শোনার জন্য ব্যক্তিগত কোনো সংগ্রহও নেই। এরা দোকানের টেলিভিশন থেকে বা অন্য কোনোভাবে গান শুনেই এত সুন্দর গান করতে পারে। আমি সত্যি খুব অবাক হই যে, এরা যদি মনের চাহিদা পূরণের জন্য, নিজের মেধাকে বিকাশ করার ন্যূনতম সুযোগ পেত তাহলে হয়তো এরাই হতো বিশ্বসেরা সঙ্গীত তারকা। আর বাংলাদেশ হতো সেই গৌরবের অধিকারী। কিন্তু এতই দূরভাগা আমরা যে এদের জন্য ন্যূনতম কোনো সুযোগ তো দূরের কথা এদের দু’বেলা খাবার ব্যবস্থা করতে পারি না। এ রকম আরও অনেক বিষয় রয়েছে যেমন, অনেকে আছে যারা রাজনীতিতে অন্যদের থেকে বেশ প্রতিভা সম্পন্ন কিন্তু তারা পায়নি তার জন্য অনুকূল পরিবেশ। পেলে তারা হয়তো বিশ্বকে নতুনভাবে গড়ার মতো কিছু দিতে পারত। কিন্তু আমার দিতে পারি না তাদের সে রকম পরিচর্যা। যেটা আমাদের ব্যর্থতা।
আমি এমন অনেক পরিবারে কথা জানি, যারা তার সন্তানকে ভালোভাবে লেখাপড়া করাতে পারে না অর্থের অভাবে। কিন্তু তাদের সন্তানের রয়েছে অদম্য মেধা ও ইচ্ছা শক্তি। একটা মেধা ঝরেপড়া একটা সমাজের বা দেশের জন্য কতটা দুঃখজনক তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। কারণ কেউ জানতো না যে, করম চাঁদ গান্ধী (মহাত্মা গান্ধী) তার মতো একজন সাধারণ মানুষ গোটা ভারতের স্বাধীনতার জন্য অবদান রাখবেন। কে জানতো গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয়া (বঙ্গবন্ধু) সেই ছেলেটাই হবে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠার মধ্যমণি। কে জানতো বিকলাঙ্গ হয়েও স্টিফেন হকিং বর্তমান শতাব্দির শ্রেষ্ঠ পদার্থ বিজ্ঞানী হবে? আব্রহাম লিংকনের মতো একজন মানুষ হবে আমেরিকার ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ শাসক কে জানতো? বারাক ওবামার মতো কৃষ্ণাঙ্গ, গরিব পরিবারের ছেলে আমেরিকার নক্ষত্রতুল্য প্রেসিডেন্ট হবে এটা কেউ জানতো না। হিটলারের মতো রাস্তার ছেলে হয়ে উঠবে বিশ্বসেরা ইতিহাস রচনার উপাদান সম খলনায়ক এটা কে জানতো? কে জানতো নরেন্দ্র মোদির মতো একজন চা বিক্রেতার ছেলে হবে ভারতের মতো এতবড় দেশের প্রধানমন্ত্রী। নেলসন মেন্ডেলার মতো একজন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে উঠবে বর্ণবৈষম্যহীন সমাজের প্রতিষ্ঠাতা- কে জানতো? এ রকম শত উদাহরণ রয়েছে ইতিহাসের উজ্জ্বল নক্ষত্রসম ব্যক্তিত্বের। তাদের উঠে আসার গল্প আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, প্রতিভার বিকাশ কতটা জরুরি একটা সমাজ-দেশ-জাতির অমূল পরিবর্তনের জন্য। মাতৃগর্ভের শিশু হিটলারও হতে পারে আবার বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠাকারীও হতে পারে। কোনো শিশু মায়ের পেট থেকে নিউটন হয়ে জন্মায় না তাকে নিউটন হওয়ার সুযোগ করে দিতে হয়। শিশু কাদামাটি তাকে সুন্দর শিল্প হিসেবেও গড়া যায় আবার তামাক খাওয়ার কলকিও বানানো যায়। তার জন্য প্রয়োজন সুযোগ, প্রয়োজন সুন্দর অনুকূল পরিবেশ। মাদার তেরেসা একবারই পৃথিবীতে আসবে এমন নয়। প্রত্যেক মেয়েই মাদার তেরেসার মতো হতে পারে, হতে পারে শিরিন এবাদির মতো বিশ্ব শান্তির দূত। যে কোনো উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সব ধরনের জনবল, যারা একটা রাষ্ট্রকে সবদিক থেকে পরিপূর্ণ করে তুলবে। প্রয়োজন একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, দার্শনিক মোট কথা মানব সভ্যতার উন্নয়নের জন্য যে ধরনের মহাপুরুষ দরকার। স্রষ্টা তার অপার করুণায় আমাদের মাঝে সব ধরনের প্রতিভাসম্পন্ন মানুষ দিয়েছেন। কথায় বলে ‘ইচ্ছা থাকলে সমুদ্রের তলার স্বর্ণ নাকে উঠে আর ইচ্ছ না থাকলে নাকের স্বর্ণ সমুদ্র তলে ঢুবে’। আমাদের যদি ভাবনা হয় বিশ্বকে নিজের দেশ-জাতি-সমাজকে আদর্শরূপে গড়ে তুলব তাহলে স্রষ্টাপ্রদত্ত এই মহাপুরুষের সেবা করতে হবে। তার মেধা ও মনন বিকাশের জন্য সুযোগ করে দিতে হবে। ‘যতনে বাড়ে রতন’ কথাটা সামান্য একটা প্রবাদ হলেও এর অর্থমূল্য অনেক। আজকের স্টেশনে গান করা শিশুটির জন্য সুযোগ করে দিতে পারলে আমরা হয়তো মাইকেল জ্যাকসনের মতো বা তার চাইতে বড় তারকা পেতাম। ঘরের মাঠের ফুটবল খেলা ছোট ছেলেটা হয়তো হতে পারত পেলে-ম্যারাডোনা-মেসির মতো বিশ্বখ্যাত তারকা ফুটবলার। অনেক মুস্তাফিজ, মাশরাফি আজও পড়ে আছে গ্রাম-বাংলার অজানা প্রান্তরে। জয়নুল আবেদিন বা কামরুল হাসানের মতো অনেক চিত্রকর লুকিয়ে আছে বাংলার ঘরে। সামান্য সুযোগ হয়তো তাদের প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারে। বাংলাদেশের মাটিতে আইনস্টাইন জন্ম নেবে না বা নিউটন হবে না কোনো বিধান নেই। মায়ের কোলের ছোট সেই খোকাই যে একদিন বিশ্ব রত্ন হবে এটা তার মা নিজেও জানত না। মেধা এমন সম্পদ যার কোনো মরণ নেই। এটি এমন অস্ত্র যার আঘাত প্রতিহত করার ক্ষমতা নেই। যার দ্বারা বিশ্বে রাজত্ব করা যায়। মেধা কোনো দল-মতের সম্পত্তি নয় এটা গোটা দেশ-জাতি ও বিশ্বের সম্পদ। বিকাশ করার জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। করতে হবে তার জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি। কবি সুকান্ত বুঝতে পেরেই বলেছিলেন শিশুর জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে। চীন, উত্তর কোরিয়াসহ বিশ্বের জনবহুল দেশগুলো জনসংখ্যার ভারে তলিয়েও যায়নি বা তারা পিছিয়েও পড়েনি। বরং তারাই আজ বিশ্বে রাজত্ব করছে। জনসংখ্যাকে তারা সমস্যা নয় সম্পদ মনে করে কাজে লাগিয়েছে। আমাদের দেশে রয়েছে চীন, উত্তর কোরিয়ার মতো উন্নয়নের সুযোগ। কারণ আমাদের সোনার খনি নেই তবে আমাদের দেশে সোনা ফলে। এদেশের মাটি বড় খাঁটি, সুবিশাল মানবসম্পদ সম্পন্ন এমন দেশ বিশ্বে বিরল। বিশ্বের কাছে উন্নয়নের দৃষ্টান্তস্বরূপ বাংলাদেশ ঈর্ষার রূপ নিয়েছে। আমি ছোট শিশুদের সঙ্গে মিশে খুব আনন্দ পাই। তাদের জানানোর কৌতূহল আমাদের অবাক করে। এদের ভাবনার জগতের সীমা অনন্তহীন। এরা অসীম কল্পনা শক্তি সম্পন্ন। ভাবুক মন ও কল্পনাশক্তি মানুষকে নতুনত্বের সন্ধান দেয়। আর নতুনত্ব বিশ্বকে পরিবর্তন করে দেয়। আমি ছোটদের সঙ্গে মেশার সময় তাদের যখন বলি, তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও? উত্তরে আমি অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকি, তাদের নয়ন মাঝে, উজ্জ্বল হাসি মাখা মুখে আগামীর বাংলাদেশ দেখি। আমি ডাক্তার হব, পুলিশ হব, আর্মিতে চাকরি করব, স্যার (শিক্ষক) হব, বিমান চালাব, ইঞ্জিনিয়ার হব.. ইত্যাদি। ওদের অবুঝ মনের আকাঙ্ক্ষা শুনে আমি অভিভূত না হয়ে পারি না। কেউ বা শাহরুখ (নায়ক), সালমানও হতে চায়, শাকিব খানের নামটাও বাদ পড়ে না। ক্যাটরিনা, প্রিয়াংকা হওয়ার আশাও আছে অনেকের। শিশুর এই ভাবনাটা, তার চাওয়াটা আমরা যথাযথ ব্যবহার করতে পারলে সোনার বাংলার স্বপ্নটা কিন্তু সুদূর পরাহত নয়। আমাদের অভিভাবকরা সন্তানদের নিয়ে অনেক ভাবেন, কিন্তু কখনো জানতে চায় না তার সন্তান কী হতে চায়। তার আশাটা কী? অভিভাবকরা যেন নিজেদের ইচ্ছা পূরণের জন্যই সন্তানকে পড়াচ্ছে। আমার কাছে অনেক বাবা-মা বিশেষ করে আমার পরিচিতজনদের মাঝে যারা আছে তারা বলে, তার ছেলে বা মেয়ে পড়তে চায় না। সন্তান পড়তে চায় না কী করতে চায় সেটা কখনো জানতে চেয়েছে এমন অভিভাবক আমি পায়নি বললেই চলে। একজন তার ছেলেকে ডাক্তার বানাবে বেশ প্রস্তুতি তার কিন্তু ছেলেকে সে অনুকূলে পাচ্ছে না। আমার কাছে তার সব চেষ্টার কথা বলল। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম যে, আপনি কি জানেন আপনার ছেলে কী হতে চায়, কখনো জানার চেষ্টা করেছেন? উত্তর হলো, ‘না’। ছেলের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম সে আর্মিতে (সেনাবাহিনী) চাকরি করবে। ছেলেটা নবম শ্রেণিতে পড়ত। তার জন্য সে নিজেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে তৈরি করে নিচ্ছে আর তার বাবা-মা তাকে ডাক্তার বানানোর জন্য বসে আছে। এভাবেই কেউ বা হতে চায় চিত্রশিল্পী, কেউ বা হতে চায় বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী, কেউ খেলোয়াড়, আবার কেউ নৃত্যশিল্পী মোট কথা তাদের প্রত্যেকেরই বড় কিছু হওয়া চিন্তা রয়েছে কিন্তু আমরা তাদের প্রতিভার সন্ধান করে তার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে রাজি না। আমাদের পরিবার-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমাজ-দেশ কেউই জানতে চায় না শিশুমনের ভাবনাটা কী? তার ইচ্ছা কী? সে কী হতে চায়? সুযোগ করে দিতে পারি না তার সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, কোনো শিশু খারাপ মানুষ হতে চায় না বা কুখ্যাত কাউকে তার আদর্শ হিসেবে নেয় না। তাহলে তার ইচ্ছার তার প্রতিভার বিকাশের সুযোগ করে দিতে বাধা কী? আমাদের শিশুরদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারলে আমাদের দেশের অমূল পরিবর্তন হয়ে যাবে। সোনার বাংলা গড়ে উঠবে আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি। লেখক : কলাম লেখক |