শিরোনাম: |
হাওরে প্রয়োজন স্থায়ী বেড়িবাঁধ ও দুই ফসলি উত্পাদন ব্যবস্থা
|
মোতাহার হোসেন : অকালে বন্যা, বৃষ্টি, ঝড় জলোচ্ছ্বাস, পাহাড়ি ঢল হলে কমবেশি দেশের সর্বত্র ফসলের ক্ষতি হয়। আবার অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরায়ও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তবে বরাবরই দেশের যেসব এলাকা বছরে শুধু একটি ফসল হয়, সেসব এলাকায় আবাদ মৌসুমে যদি অকালে, অসময়ে অতিবৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল নামে তাহলে এসব অঞ্চলের কৃষক, মজুর থেকে শুরু করে কৃষিনির্ভর মানুষের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে। এবার হয়েছেও তাই। দেশের হাওর-বাঁওড় অধ্যুষিত অঞ্চলের মানুষ এমনই দুঃসময় অতিক্রম করছেন। বলা যায় তারা অতিক্রম করছেন অন্ধকার সময়। আগামী একটি বছর অন্তত অভাব, অনটন, অর্ধহার, অনাহারকে সঙ্গী করে দিন যাপন করতে হবে অনেক হাওরবাসীকে। পাহাড়ি ঢল আর বন্যায় হাওর-বাঁওড়ের অসংখ্য মানুষের ক্ষেতের পাকা, অর্ধপাকা, কাঁচা ধান তলিয়ে গেছে। একই সঙ্গে তলিয়ে গেছে তাদের সোনালি ধান ঘরে তোলার স্বপ্ন, বেঁচে থাকার অবলম্বন। কৃষকের ঘরে সোনালি ধান ঘরে তোলার স্বপ্ন এখন হাওরের অথৈ পানির নিচে ডুবে তা কষ্টের কান্নায় রূপ নিয়েছে। এ বিপর্যয়ে তাদের বিষণ্ন এবং ভবিষ্যেক করেছে তুলেছে চরম অনিশ্চিত। হাওর অঞ্চলে অসময়ে পাহাড়ি ঢল, আর অকাল বন্যায় কমপক্ষে ৭ হাজার কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়েছে বলে পত্রপত্রিকার খবরে জানা গেছে। বিশেষ করে কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহের আংশিক, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে এই অকাল বন্যা আর পাহাড়িঢলে। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত কিশোরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ সফর করে এ থেকে পরিত্রাণে স্থাীয় বেড়িবাঁধ নির্মাণের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। আমরা প্রত্যাশা করছি সরকার হাওরবাসীদের রক্ষায় রাষ্ট্রপতির পরামর্শ বাস্তবায়ন করবে।
গত কয়েকদিন ধরে গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, হাওর-বাঁওড় অধ্যুষিত সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ,কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ময়মনসিংহের আংশিক, নেত্রকোনা ও হবিগঞ্জ হাওর অধ্যুষিত অঞ্চলের ক্ষেতের পাকা ধান, আধাপাকা, কাঁচা ধান পাহাড়ি ঢল ও বন্যায় পনির নিচে তলিয়ে গেছে। বিপুল পরিমাণ জমির ধান কোথাও সম্পূর্ণ, কোথাও আংশিক জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার যেসব জমির ধান পেকেছে সেসব জমির ধান পানির নিচে ডুবে যাওয়ায় ধান কাটতে সময় ও অর্থ খরচ হচ্ছে বেশি। কৃষকরা ফসল বোনার সময় নেয়া মহাজনের ঋণ, ব্যাংকের ঋণের সুদ ও দায়দেনায় জর্জরিত। অবশ্য সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী এসব অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের ব্যাংক ঋণের সুদ মওকুপ এবং ঋণ পরিশোধ স্থগিত ঘোষণায় তাদের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি এসেছে। তবে পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে, কোথাও কোথাও মহাজন, বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণের টাকা এবং সুদ পরিশোধে চাপ দিচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের। এ নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কাজ করা দরকার। এখানে আরকটি বিষষয় কৃষিবিদ ও সংশ্লিষ্ট গবেষকদের গবেষণা করে বের করা দরকার দেশের হাওর-বাঁওড় অধ্যুষিত ৭ জেলা বছরের বেশিরভাগ সময় পানির নিচে তলিয়ে থাকে বা নিমজ্জিত থাকে বিধায় সেসব নিমজ্জিত এলকায় বছরে বর্তমানে এক ফসলের পরিবর্তে দুই ফসল করা যায় কিনা তা ভেবে দেখবেন। তাহলে অন্তত এসব অঞ্চলের মানুষ এক ফসল নষ্ট হলে দ্বিতীয়বার চাষের উদ্যোগ নিলে ক্ষতি কিছুটা কাটিয়ে ওঠতে পারবেন। প্রয়োজনে সরকার এ ব্যাপারে কৃষি বিজ্ঞানীদের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিতে পারেন। বিগত ৪০ বছর পর এমন ভয়ানক দুর্যোগের মুখে পড়েননি হাওর পাড়ের ৭ জেলার মানুষ। গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে মেঘনা, কালনী, কুশিয়ারা, ধনু, দাইরা, ঘোড়াউত্রা, ধলেশ্বরী, করাতিয়া, কলকলিয়া, বৈঠাখালী, কলমারবাক নদীতে অস্বাভাবিকভাবে পানি বেড়েছে। পানির তোড়ে ভেঙে গেছে বাঁধ। বোরো ফসল রক্ষায় বেড়ি বাঁধগুলোতে দিনব্যাপী স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করে যাচ্ছেন হাজারো মানুষ। তবে প্রাণপণ চেষ্টা সত্ত্বেও বাঁধের ভাঙন ঠেকানো যাচ্ছে না। সরকারি হিসাবে ডুবে গেছে, প্রায় ৯০ হাজার হেক্টর জমি। পানিতে তলিয়ে যাওয়া হাওরের এসব জমিতে প্রায় দুই লাখ ৪০ হাজার টন চাল পাওয়া যেত। ধারণা করা হচ্ছে, এর ফলে ৭২০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তবে স্থানীয় একটি সংগঠনের হিসাবে সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় এক হাজার ৭০০ কোটি টাকা। তবে এই ক্ষতির পরিমাণ দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাঁধ ভেঙে ও পানি উপচে এক নিমিষেই তলিয়ে গেছে সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, বিবাড়িয়া, মংমনসিংহ জেলার আংশিক ও হবিগঞ্জের লাখ লাখ হেক্টর জমির ফসল। মৌসুমি ধান কাটা শ্রমিক আসার আগেই হাওর তলিয়ে যাওয়ায় স্থানীয় ধান কাটা শ্রমিকের চাহিদা বেড়ে গেছে। ২৫০ টাকার বিপরীতে অনেককে ছয়শ’-সাতশ’ টাকায়ও শ্রমিক সংগ্রহ করে ধান কাটাতে দেখা গেছে। তারপরও শ্রমিক মিলছে না। অনেক কৃষক শ্রমিক না পেয়ে হাওরের পাড়ে বসে নিজের তলিয়ে যাওয়া জমির দিকে তাকিয়ে বিলাপ করছেন। কৃষকরা বলছেন, ১৯৭৭ সালের পর এক ফসলি আবাদের এ অঞ্চলে এমন দুর্যোগ তাদের সর্বস্বান্ত করে দিয়েছে। অনেকে ঋণ নিয়ে জমি আবাদ করেছিল। এখন তাদের পথে নামা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। হাওরে এবার পানি এসেছে একটু আগেভাগেই। প্রতি বছর শীত এলে এই বাঁধগুলো নতুন করে সরকারি উদ্যোগে মাটি দিয়ে শক্ত করে ভরাট করা হয়। কিন্তু এবার বর্ষা এলে হাওরের কোনো বাঁধই আর আস্ত থাকে না। পানির স্রোতের নিচে মিশে যায়। তখন গ্রাম থেকে দূরে দৃষ্টি দিলে শুধু পানি আর পানি। গ্রামের কিনারে বেড়ি বাঁধের চিহ্নও চোখে পড়ে না আর। এরপরও বর্ষার আগে যাতে পানি হাওরে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য এই বাঁধ এবং এটাই যুগ যুগ ধরে সাক্ষী হয়ে আছে পানি ও ধানের মাঝখানে কালের এক বিরাট দেয়াল হিসেবে। হাওর রক্ষা বাঁধে অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে দুর্বল বাঁধ ভেঙে যায় বলে বহুদিনের অভিযোগ হাওরবাসীর। মরমী কবি ও গবেষক ইবনে সালেহ মুনতাসির রচিত ‘হাওর-বাঁওড়’ শীর্ষক লিরিকটি প্রাসঙ্গিক। ‘হাওর-বাঁওড় জলাশয় নদনদী খাল বিল ডোবা জল/আবহমান বাংলার পরিচয় ছিল একদা শ্বাপদ সংকুল/দিক বিজয়ী সাহসী যোদ্ধা বণিক ভাগ্যান্বেষীদের নিয়ামতপুরী/ধনধান্য পুষ্পে ভরা শস্য শ্যামলিমা সুস্বাদু মাছ আর খাদ্যশস্যের কল্পতরী.. যুগ বদলেছে দিন বদলেছে বদলেছে হাওরের হালচিত্র/অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে হাওর নহে আর কৃষকের মিত্র/পাহাড়ি গোলা ঢলে হাওরের ফসলি জমি যায় যে তলিয়ে/মহাজনি ঋণের সুদ ব্যাংকের ঋণ সুদের দায়ে কৃষকদের দুর্দশা কান্না যায় যে সব ছাড়িয়ে/..উজান দেশের বাঁধের কারণে পাহাড়ি গোলার ঢলের ফ্লাসে সারা হাওর বন্যায় ভাসে/এভাবে খাদ্য ভাণ্ডার ফুরালে জাতির আমদানির উপায় কি’ এখানে উল্লেখ্য, সারাদেশের এক-পঞ্চমাংশ ধান হাওর এলাকায় উত্পাদিত হয়। শুকনো মৌসুমের ৬ মাস শুধু বোরো ফসল নিয়ে ব্যস্ত থাকেন হাওরবাসী। একমাত্র এই ফসলের ওপরই নির্ভরশীল তাদের জীবন ও জীবিকা। প্রায় প্রতি বছরই পাহাড়ি ঢল, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, প্রাকৃতিক দুর্যোগে হাওরবাসী কৃষকদের সুখ-স্বপ্ন-সাধ পানিতে ভেসে যায়। ঋণ, লগ্নি আর খেয়ে-না খেয়ে যে ফসল ফলানো হয় তা তলিয়ে গেলেও কিছুই করতে পারে না কৃষক। হাওর রক্ষা বাঁধগুলোকে আজও স্থায়ীভাবে গড়ে তোলা হয়নি। বাঁধ নির্মাণ এবং মেরামতে শুভঙ্করের ফাঁকি থাকায় এ বিপর্যয় এড়ানো যায় না। হাওরের ফসল ঠিকমতো ঘরে তুলতে পারলে ১০ বছরেই পাল্টে যেত দেশের অর্থনীতির চেহারা। অথচ এসব সম্ভাবনা কাজে লাগাতে কার্যকর ব্যবস্থা লক্ষণীয় হচ্ছে না। এ সমস্যা সমাধানে সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্যই টেকসই ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। বন্যা ও ফসলহানির দুরবস্থা থেকে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক-জনগণকে রক্ষার জন্য সমগ্র এলাকাকে দুর্যোগপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করা দরকার। ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে রিলিফ বিতরণ, ক্ষতিগ্রস্তরে মধ্যে পর্যাপ্ত রেশনের ব্যবস্থা করা, পশু সম্পদ রক্ষায় পশুখাদ্য সরবরাহ করা এবং ফসলহানির কারণে সব ধরনের কৃষিঋণ সম্পূর্ণ মওকুফ দরকার। একই সঙ্গে হাওর অঞ্চলের মানুষকে এ রকম প্রকৃতিক দুর্যোগ থেকে স্থায়ীভাবে রক্ষায় সময় মতো পরিকল্পিত বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা দরকার। এ ক্ষেত্রে হাওর অঞ্চলের নদীসমূহের গভীরতা ও নাব্য সৃষ্টির জন্য নদী খনন-ড্রেজিং করা দরকার। সোমেশ্বরী, জাদুকাটা, রক্তি, বৌলাই, চলতি, কংশ উপ-নদীসমূহ খনন করে সুরমা নদী পর্যন্ত ড্রেজিং এবং সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর ভরাটকৃত অংশসমূহ খনন করে মেঘনা নদী পর্যন্ত পানি প্রবাহের গতি বৃদ্ধি করতে হবে। নদীর গভীরতা ও নাব্য সৃষ্টি হলে বর্ষা শেষে হাওরের পানি দ্রুত সরে যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি হবে। নদীর খননকৃত মাটি দিয়ে নদীর পাড়/তীর বেঁধে দিয়ে পানির প্লাবন রোধ করার ব্যবস্থা করতে হবে। এসব করা সম্ভব হলে হাওর এলাকার কৃষকরা তাদের সোনার ফসল সময়মতো ঘরে তুলতে পারবে নিশ্চিন্তে। নেত্রকোনার খালিয়াজুড়িতে পাহাড়ি ঢলের তোড়ে উপজেলার কীর্তনখোলা বাঁধ ভাঙ্গার পর আরও ৯টি ছোট-বড় ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে গেছে। গোটা হাওরাঞ্চলের কৃষক পরিবারগুলোতে এখন চলছে আহাজারি। ধনু নদী দিয়ে বয়ে আসা পাহাড়ি ঢলের চাপে মেন্দিপুর ইউনিয়নের নাওটানা, পুটিয়া, পেটনা, কুড়পার এবং গাজীপুর ইউনিয়নের কেওরালা, কুমারিয়া, কেদারিয়া, পুইট্যা এবং খৈল্যার বাঁধ ভেঙে গেছে। বাঁধ ভাঙা পানিতে মেন্দিপুরের রোয়াইল, ঝালখালি, পুটিয়া, পেটনা এবং গাজীপুরের বুড়বুড়িয়া, বেড়ি ও ফেনার হাওরসহ অন্তত ২০টি ছোট বড় হাওরের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ বোরো ধান তলিয়ে গেছে। নেত্রকোনার কেন্দুয়া নদীর পানি বিভিন্ন হাওর-বিলে ঢুকে পড়ায় নদী তীরবর্তী নিচু এলাকার বোরো ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। এ জেলার বিস্তীর্ণ হাওর এলাকাসহ ৬টি উপজেলায় ২৫ হাজার হেক্টর জমির উঠতি বোরো ফসল পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। কিশোরগঞ্জের তাড়াইল, ইটনা, মিটাইমন, অষ্টগ্রামের শত ভাগ জমির ফসল সম্পূর্ণ তলিয়ে গেছে পানিতে। টানা বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে এসব অঞ্চলের কৃষক দিশাহারা এবং সর্বশান্ত। হাওরে যে দিকে চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। এ অবস্থায় স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের পাশাপাশি বছরব্যাপী ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের খাদ্য ও আর্থিক সহায়তার বিষয়টি সরকার বিবেচনা করবে- এমন প্রত্যাশা করছি। লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক |