সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
অসাম্প্রদায়িক চেতনার উৎসব পহেলা বৈশাখ
Published : Wednesday, 12 April, 2017 at 6:00 AM, Count : 1208

স্বপন কুমার সাহা : ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় মানুষ কিছু ঘটনা এবং স্মৃতিকে আপন করে নেয়। আর এ আপন করে নেয়ার বিভিন্ন স্তর এবং সময়ের পথ ধরেই ঘটে সংস্কৃতির বিকাশ। প্রতিটি জাতি ও সভ্যতা সংস্কৃতির মাধ্যমে খুঁজে পায় তার নিজস্ব অনুভূতি এবং স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। বাঙালি জাতি হিসেবে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আমাদের এমন একটি উত্সব পহেলা বৈশাখ। পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। সব ধরনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে এক কাতারে শামিল হয়ে বাঙালি সংস্কৃতিকে সুউচ্চে তুলে ধরতে পয়লা বৈশাখের মতো উত্সব আর দ্বিতীয়টি নেই। সে কারণে এ দিনটি বাঙালি জাতির জীবনে এক অনন্য তাত্পর্যের দিন।
ভারতে ইসলামি শাসনামলে হিজরি পঞ্জিকা অনুসারেই সব কাজকর্ম পরিচালিত হতো। মূল হিজরি পঞ্জিকা চন্দ্র মাসের ওপর নির্ভরশীল। চন্দ্র বছর সৌর বছরের চেয়ে ১১-১২ দিন কম হয়। এ কারণে চন্দ্র বছরে ঋতুগুলো ঠিক থাকে না। আর চাষাবাদ ও এ জাতীয় অনেক কাজ ঋতুনির্ভর। এ জন্য মোঘল সম্রাট আকবরের সময়ে প্রচলিত হিজরি চন্দ্র পঞ্জিকাকে সৌর পঞ্জিকায় রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, সম্রাট আকবার তার দরবারের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লাহ সিরাজীকে হিজরি চন্দ্র বর্ষপঞ্জীকে সৌর বর্ষপঞ্জীতে রূপান্তরিত করার দায়িত্ব প্রদান করেন। ৯৯২ হিজরি মোতাবেক ইংরেজি ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর এ হিজরি সৌর বর্ষপঞ্জীর প্রচলন করেন। তবে তিনি ঊনত্রিশ বছর পূর্বে তার সিংহাসন আরোহণের বছর থেকে এ পঞ্জিকা প্রচলনের নির্দেশ দেন। এ জন্য ৯৬৩ হিজরি সাল থেকে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়। ইতিপূর্বে বঙ্গে প্রচলিত শকাব্দ বা শক বর্ষপঞ্চির প্রথম মাস ছিল চৈত্র মাস। কিন্তু ৯৬৩ হিজরি সালের মহররম মাস ছিল বাংলা বৈশাখ মাস, এ জন্য বৈশাখ মাসকেই বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং ১ বৈশাখকে নববর্ষ ধরা হয়।
মোঘল সময় থেকেই পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে কিছু অনুষ্ঠান করা হতো। প্রজারা চৈত্রমাসের শেষ পর্যন্ত খাজনা পরিশোধ করতেন এবং পহেলা বৈশাখে জমিদাররা প্রজাদের মিষ্টিমুখ করাতেন এবং কিছু আনন্দ উত্সব করা হতো। এছাড়া বাংলার সব ব্যবসায়ী ও দোকানদার পহেলা বৈশাখে ‘হালখাতা’ করতেন। এভাবে ধীরে ধীরে পয়লা বৈশাখ একটি সর্বজনীন ও অসাম্প্রদায়িক উত্সবে পরিণত হয়।
ইতিহাস থেকে জানা আরও জানা যায় যে, আগে বৈশাখের অনুষ্ঠানের চেয়ে চৈত্র সংক্রান্তির অনুষ্ঠান ছিল আকর্ষণীয়। এই রেশ ধরেই বৈশাখের পদার্পণ। এখনও চৈত্রের শেষ দিনে গাঁয়ের বধূরা বাড়ি ঘর পরিষ্কার করে। বিশেষ করে পানিতে মাটি ছেনে ঘরের ভেতরে ও আঙ্গিনায় লেপে দেয়। উঠান ঝকঝকে পরিষ্কার করে রাখে।
ইতিহাসের পালাবদলে বাংলার শাসন ক্ষমতায় অনেক পরিবর্তন আসে। এক সময় পুরো ভারতবর্ষের ক্ষমতা দখল করে ইংরেজ বেনিয়া শক্তি। তাদের ক্ষমতার শেষে গঠিত হয় স্বাধীন ভারত বর্ষ তথা ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র। তবে বিবেচ্য বিষয় হলো ক্ষমতার যতই পালাবদল হোক না কেন এ অঞ্চলের মানুষ সব সময়ই অসাম্প্রদায়িক চেতনায় জীবনযাপন করত। আবহমান বাংলার মুসলমান-হিন্দু তথা সব জাতি-ধর্মের মানুষের অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা ইতিহাসের পাতায় পাতায় উল্লেখ রয়েছে। পৌষ পার্বণ তথা পয়লা বৈশাখ আবহমান কাল থেকেই বাংলার মানুষের প্রাণের উত্সব। এ উত্সব সবার। এ উত্সব সব সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বের এক চেতনা।
তবে দুঃখের বিষয় ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পর সর্বজনীন পয়লা বৈশাখকে সাম্প্রদায়িকতার আখ্যা দিয়ে বাংলার এই অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল তত্কালীন পাক শাসক চক্র। তারা বাঙালির এ চেতনাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল ‘হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি’ আখ্যা দিয়ে। এরই ধারাবাহিকতায় এক পর্যায়ে বাংলা সংস্কৃতির ওপর কালো থাবা বিস্তারে তত্কালীন পাকিস্তান সরকার পূর্বপাকিস্তানে রবীন্দ্রসংগীতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
পাকিস্তান সরকারের এই অন্যায় আচরণের জবাব দিতেই সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ছায়ানট’ ১৯৬৫ সালের ১৪ এপ্রিল (১ বৈশাখ, বাংলা ১৩৭২ সন) রমনার বটমূলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ গানটি দিয়ে সর্বপ্রথম যাত্রা শুরু করে। শিল্পী সানজিদা খাতুনের নেতৃত্বে ছায়ানটে আনুষ্ঠানিকভাবে এ পয়লা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত রমনার বটমূলে বর্ণিল আয়োজনে এ উত্সব পালন হচ্ছে। এ দিন ঢাকায় শহুরে নাগরিকদের গত্বাঁধা জীবনযাত্রায় যোগ হয় ভিন্নতার স্বাদ। সকালেই নগরবাসী ঘর থেকে বের হয় সুসজ্জিত হয়ে। নারী ও কিশোরীরা পরেন লাল-সাদা শাড়ি, পুরুষরা পরেন নকশা করা পাঞ্জাবি ও ফতুয়া। আর মা-বাবার সঙ্গে থাকে গালে আলপনা আঁকা ফুটফুটে শিশুরা। পরিবার-পরিজন নিয়ে এভাবে বর্ষবরণ যেন জাগ্রত করে বাঙালির জাতীয়তাবোধ। শুধু ঢাকা নয়, দেশের সর্বত্রই এ উত্সব পালিত হয় ব্যাপক উত্সবের আমেজে। এ যেন সব বাঙালির একাত্ম হওয়ার এক প্রাণময় উত্সব।
১৯৮৯ সাল থেকে পয়ল বৈশাখের আয়োজনে যুক্ত হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। বৈশাখ উদযাপনের অন্যতম তীর্থকেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বৈশাখের ভোরে এ শোভাযাত্রা শুরু হয়। শুধু রাজধানী নয়, এখন দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন দেখা যায়।
এটা আমাদের বৈশাখ উদযাপনে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। সম্প্রতি বাংলা বর্ষবরণের অন্যতম অনুষঙ্গ এ মঙ্গল শোভাযাত্রাকে জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে। ইউনেস্কো বলেছে, মঙ্গল শোভাযাত্রা বাংলাদেশের মানুষের সাহস আর অশুভের বিরুদ্ধে গর্বিত লড়াই আর ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষার প্রতীকী রূপ। ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ পরিচয় নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণকেও মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয় সংস্থাটি।
আর এ স্বীকৃতি আমাদের জন্য এক বিশাল পাওয়া। বাংলার অসাম্প্রদায়িক চেতনার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এছাড়া বৈশাখের সকালে পান্তা-ইলিশ খাওয়াও এখন একটি সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। বৈশাখের আরেকটি উত্সব হলো হালখাতা। অবশ্য নগরজীবনে হালখাতার প্রভাব কম। দেশের বিভিন্নস্থানে গ্রামের ব্যবসায়ীদের কাছে এ উত্সবটি ব্যাপক জনপ্রিয়। তারা পুরনো বছরের বকেয়ার হিসান-নিকাশ মেটাতে হালখাতার আয়োজন করে থাকে। গ্রাহকরা তাদের বকেয়া পরিশোধ করে। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এ সময় তাদের মিষ্টিমুখ করান ব্যবসায়ীরা। এ যেন এক শাশ্বত প্রাণের মেলবন্ধন। যদিও এক সময় হালখাতাকে হিন্দুদের উত্সব হিসেবে গণ্য করা হতো, কিন্তু এটি এখন একটি সর্বজনীন উত্সবে পরিণত হয়েছে। এছাড়া বৈশাখ উপলক্ষে গ্রামে গ্রামে আয়োজন করা হয় বৈশাখি মেলা। দূর-দূরান্ত থেকে মেলায় দর্শক ও ক্রেতা-বিক্রেতারা আসেন। এ যেন আবহমান বাংলার এক অনন্য একাত্মতার উত্সব।
পয়লা বৈশাখ মানে বাঁধভাঙা আনন্দের জোয়ার, সব প্রাণের এক হয়ে যাওয়া। বর্ষবরণে মানুষের প্রাণোচ্ছল উপস্থিতি বারবার এটাই প্রমাণ করে যে, বাঙালি ধর্মান্ধতায় বিশ্বাস করে না, সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করে না, মানুষে মানুষে বিভাজনে বিশ্বাস করে না। জীবনবোধ, জীবনযাত্রা, প্রকৃতির বিচিত্রতার নিরীখে বর্ষবরণ আমাদের সংস্কৃতি। সুর-সংগীত, মেলা, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, হূদ্যতার মেলবন্ধনে ভাস্বর পয়লা বৈশাখ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় হাজার বছরের লালিত সংস্কৃতির ঐতিহ্যের ধারা, প্রেরণা দেয় সুস্থ সংস্কৃতি চর্চাকে। এ উত্সব তাই আবহমান কালের অসাম্প্রদায়িক গণসচেতনতার পদক্ষেপ। বাঙালি হিসেবে আমরা সত্যিই ভাগ্যবান যে, আমাদের জাতীয় জীবনে এমন উত্সব রয়েছে যা সমাজের প্রতিটি মানুষকে এক অসাম্প্রদায়িকতার সুঁতোয় বাঁধতে সক্ষম। বাঙালি জাতিগতভাবেই অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্ভুদ্ধ। আর এসব উত্সব বাঙালির অসাম্প্রদায়িক এ বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করে রেখেছে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, সাম্প্রতিক সময়ে উগ্রপন্থা তথা জঙ্গিবাদের কালো থাবা পড়েছে আমাদের অসাম্প্রদায়িক এই প্রিয় মাতৃভূমিতে। একটি বিশেষ গোষ্ঠী তাদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য এ উগ্রপন্থার বিকাশে মদদ দিচ্ছে। গত বছরে রাজধানীর হলি আর্টিজানে হামলার মধ্য দিয়ে দেশে নব্য ধারার যে জঙ্গিবাদের সূচনা হয়, তা এখন দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে আশার কথা আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব জঙ্গিদের দমনে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে।
এই জঙ্গিবাদের পেছনে ক্ষমতালোভী এই গোষ্ঠীটির যে মদদ রয়েছে তা বিভিন্ন সময় ওই গোষ্ঠীটির বিভিন্ন কার্যকলাপ তথা বক্তব্য বিবৃতিতে প্রতীয়মান হয়। তবে আমি বলতে চাই রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শেরে বাংলা, সোহরায়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই অসাম্প্রদায়িক বাংলায় জঙ্গিবাদ কখনো টিকতে পারবে না। এ দেশের মানুষ জঙ্গিবাদ তথা সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করে না। অসাম্প্রদায়িকতাই এ দেশের মানুষের জীবনের গভীর দর্শন। আর এ দর্শনের কেন্দ্রে রয়েছে পয়লা বৈশাখ ও একুশে ফেব্রুয়ারির মতো সর্বজনীন উত্সবের চেতনা। তাই বলতে চাই, এই বাংলাকে নিয়ে যত ষড়যন্ত্রই হোক না কেন, বাংলার মানুষের অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অনন্তকাল বেঁচে থাকবে। আর পয়লা বৈশাখের চেতনার মধ্য দিয়ে পরাজয় হোক সব অশুভ শক্তির, জাগ্রত হোক শুভ চিন্তা ও বুদ্ধির। ছড়িয়ে পড়ুক অসাম্প্রদায়িকতার শাশ্বত চেতনা।

    লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক বর্তমান।



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : [email protected], [email protected]
Developed & Maintainance by i2soft