শিরোনাম: |
বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত রিপোর্ট
অভিনব কায়দায় সাউথ বাংলা ব্যাংকের ৫৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন চেয়ারম্যান
|
প্রায় ১৮ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের আশঙ্কা বাংলাদেশ ব্যাংকের চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবি পরিচালক ও শেয়ারহোল্ডারদের ভাইস-চেয়ারম্যানকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দিয়ে সুষ্ঠু তদন্তের দাবি ১ কোটি ৯২ লাখ টাকার জমি বন্ধক রাখা হয়েছে ২৭ কোটি টাকা দেখিয়ে রহমান আজিজ : সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের (এসবিএসি) চেয়ারম্যান এসএম আমজাদ হোসেনের বিরুদ্ধে ৫৭ কোটি ২০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে প্রায় ১৮ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের আশঙ্কা রয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত রিপোর্টে উঠে এসেছে। কোনো নিয়মের তোয়াক্কা না করে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ এ অর্থ আত্মসাতের জন্য চেয়ারম্যানকে অপসারণ দাবি জানিয়েছেন ব্যাংক পরিচালক ও শেয়ারহোল্ডাররা। এছাড়া ভাইস-চেয়ারম্যানকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দিয়ে পাচারকৃত ও আত্মসাত্কৃত অর্থ উদ্ধারে সুষ্ঠু তদন্ত এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও জানান তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন রিপোর্টে দেখা গেছে, ২০১৬ সালের ২৮ জানুয়ারি জয়েন্ট স্টক কোম্পানি থেকে লাইসেন্স নেয় মেসার্স আলফা এক্সোসোরিজ অ্যান্ড এগ্রো এক্সপোর্ট লিমিটেড। মো. আরজান আলী ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হিসেবে দেখানো হয় আমজাদ হোসেনের মেজ ভাই মো. রুহুল কুদ্দুসের ১৯ বছরের মেয়ে মাহফুজা খাতুন রিশাকে। এরপর ১৫ ফেব্রুয়ারি সাউথ বাংলা ব্যাংকের বাগেরহাটের কাটাখালি শাখায় মেসার্স আলফা এক্সোসোরিজ অ্যান্ড এগ্রো এক্সপোর্ট লিমিটেডের নামে একটি হিসাব খোলা হয়। যার হিসাব নম্বর ০১১১১০০০১২৬৮৭০। ঋণ আবেদন করা হয় ১ মার্চ। ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক বিধান কুমার সাহা কোম্পানি পরিদর্শনপূর্বক একটি রিপোর্ট দেন। যেটি অত্যন্ত দায়সারা গোছের বলে প্রতীয়মান হয়। আলফা এক্সোসোরিজ অ্যান্ড এগ্রো এক্সপোর্ট লিমিটেড ৩০ শতাংশ সিভিল ওয়ার্ক সম্পাদন করেছে বলে যে প্রত্যয়ন করা হয়েছে তাও ছিল দায়সারা। কোম্পানির ফিজিবিলিটি রিপোর্টে কোনো প্রকার মন্তব্য করা হয়নি। শাখা ব্যবস্থাপক অত্যন্ত সুকৌশলে ৩ মার্চ তারিখে পরিদর্শন রিপোর্টে জমা দেন। এরপর ৪ ও ৫ মার্চ শুক্র ও শনিবার ছিল সাপ্তাহিক ছুটি। ৮ মার্চ প্রতিষ্ঠানটির অনুকূলে প্রায় ২০০ কোটি টাকা কম্পোজিট লিমিট মঞ্জুরির জন্য ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের ঋণ বিভাগে সুপারিশ করা হয়। প্রতিষ্ঠানের প্রজেক্ট প্রোফাইল পরীক্ষা করে দেখা যায়, প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয় ২১২ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে কোম্পানির ভূমি উন্নয়ন বাবদ ২৭ কোটি ২০ লাখ টাকা, ভবন নির্মাণ ব্যয় ৫৪ কোটি ১২ লাখ টাকা, মেশিনারিজ ও ইক্যুইপমেন্টের জন্য ১২৩ কোটি ১৬ লাখ টাকা, আইডিপিপি সুদ পরিশোধ বাবদ ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা এবং বিবিধ খরচ বাবদ ৩ কোটি ১৫ লাখ টাকার ঋণ প্রস্তাব করা হয়। ঋণ বিভাগ ১৫ মার্চ ১৪৪৮/৪৫ নম্বর মেমোর মাধ্যমে ৩৯ নম্বর এজেন্ডায় ঋণ হিসাবটি ব্যাংকের ৪৫তম সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপিত হয়। পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠানটির অনুকূলে কারখানা ভবন নির্মাণে ১৮ কোটি এবং এলসির ইনার লিমিট ১৫ কোটি টাকা ফান্ডেড ঋণ এবং মেশিনারিজ আমদানি বাবদ ১৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা নন-ফান্ডেড সব মিলিয়ে ৪৮ কোটি ৮০ লাখ টাকার ঋণ মঞ্জুর করা হয়। রিপোর্টে দেখা গেছে, কারখানা ভবন নির্মাণে ১৮ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর থাকলেও ৩০ জুন সময় শেষে দেখা গেছে প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন ছাড়া আরও ৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। অর্থাত্ ১ মার্চ ঋণ আবেদনের সময় হতে ৩০ জুন সময় পর্যন্ত মোট ৫৭ কোটি ২০ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। ২০ মার্চ প্রধান কার্যালয়ের এসবিএসি/ এইচও/ ক্রেডিট/২০১৬/৮৪০ নম্বর পত্রে ব্যাংক শাখাকে অতিবাহিত করা হয়। চার্জ ডকুমেন্টসমূহ যথাযথ পূরণ না করে ২৩ মার্চ তারিখেই ঋণ হিসেবে উত্তোলনের সুবিধা প্রদান করা হয়। রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়, এ অর্থ ওইদিনই ঋণ গ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের চলতি হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। প্রতিষ্ঠানের ০১১১১০০০১২৬৮৭০ নম্বর চলতি হিসাব থেকে ওই ব্যাংকের চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেনের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান লকপুর গ্রুপের বিভিন্ন হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন রিপোর্ট পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২৩ মার্চ ঋণ হিসেবে ৫ কোটি টাকা উত্তোলন সুবিধা প্রদান করা হয়। ওই দিনই এ অর্থের মধ্যে ০৮৭৩৯৭৫ ও ০৮৭৩৯৭৬ নম্বর চেকের মাধ্যমে নগদে ৩৬ লাখ টাকা জসিমকে, ৭৯ লাখ টাকা আলম এবং ৮৫ লাখ টাকা মিঠুকে প্রদান করা হয়। এই তিনজনই লকপুর গ্রুপের কর্মকর্তা। একই তারিখে বায়েজীদ স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজকে ৩ কোটি টাকা হস্তান্তর করা হয়। এরপর ২৭ মার্চে ২৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঋণ বিতরণ করে ব্যাংক। এ ঋণও লকপুর গ্রুপের কর্মকর্তা শহীদুল, ইমতিয়াজ এবং শরীফুলকে ০৮৭৩৯৭৯, ০৮৭৩৯৮১ ও ০৮৭৩৯৮০ নম্বর চেকের মাধ্যমে ১০ লাখ, ৬ লাখ ৫০ হাজার এবং ৭ লাখ টাকা দেয়া হয়। রিপোর্ট অনুয়ায়ী, বড় অঙ্কের ঋণের অর্থ ব্যাংকের কাটাখালী শাখার পরিবর্তে খুলনা শাখা থেকে নগদে প্রদান করা হয়। এর মধ্যে ২৪ মার্চ ১ কোটি, ২৮ মার্চ ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ২৯ মার্চ ২ কোটি এবং ৩০ জুন ৫ কোটি ৬৫ লাখ টাকা প্রদান করা হয়। এর মধ্যে লকপুর গ্রুপের ডিজিএম মো. রেজাউর আলম শাহীনকে ২৪ মার্চ ০৮৭৩৯৭৮ নম্বর চেকের মাধ্যমে ১ কোটি টাকা নগদে প্রদান করা হয়। ২৯ মার্চ শাহীনকে সিডিএ-০৮৭৩৯৮৩ নম্বর চেকের মাধ্যমে ২ কোটি টাকা প্রদান করা হয়। একইভাবে ৩০ জুন ছাড়কৃত ৫ কোটি ৬৫ লাখ টাকার মধ্যে ০৮৭৩৯৮৪, ০৮৭৩৯৮৫ ও ০৮৭৩৯৮৬ নম্বর চেকের মাধ্যমে লকপুর গ্রুপের ডিজিএম আনোয়ার জাহিদকে (আলম) ১ কোটি ৫০ লাখ, ২ কোটি ১০ লাখ ৯৫ হাজার এবং ১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা নগদে পরিশোধ করা হয়। এছাড়া ১০, ১৩, ২৪, ২৭, ২৮ এপ্রিল ও ২ জুন তারিখে আলফা এক্সোসোরিজকে বিতরণকৃত ঋণ মোট ১০ কোটি টাকা লকপুর গ্রুপের বিভিন্ন কর্মকর্তারা নগদে উত্তোলন করেন। রিপোর্টটি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৬ সালের ১ মার্চ তারিখে ঋণ আবেদনের প্রাপ্তির একদিন পর ৩ মার্চ প্রকল্পের চলমান কাজের অগ্রগতি পরিদর্শন, ঋণ আবেদনপত্র দাখিলের মাত্র ৪ কার্যদিবসের মধ্যে উপস্থাপিত দালিলিক কাগজপত্র পরীক্ষণ, সাইট পরিদর্শনপূর্বক ভূমি উন্নয়ন, বিভিন্ন সংস্থাপন সংক্রান্ত তথ্যাদি যাচাই, মালামাল আমদানি সংক্রান্ত কাগজপত্র পরীক্ষণপূর্বক নতুন প্রকল্পে ঋণ মঞ্জুর প্রস্তাব প্রেরণ অবিশ্বাস্যভাবে দ্রুত ও স্বল্পতম সময়ে প্রেরণ করা হয়েছে। ঋণ আবেদন দাখিলের মাত্র ২০ দিনের মধ্যে ঋণ মঞ্জুর করায় ঋণ মঞ্জুরি প্রক্রিয়ায় উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অযাচিত হস্তক্ষেপ এবং অসত্ উদ্দেশ্য রয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে। ঋণ আবেদনপত্রের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট শাখার রিপোর্টে বলা হয়েছিল, আলফা এক্সোসোরিজ অ্যান্ড এগ্রো এক্সপোর্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরজান আলীর ১০ বছরের ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা রয়েছে। এবং তার নামে ৫ লাখ টাকার একটি এসএমই টার্ম লোন রয়েছে, ঋণটি নিয়মিত আছে। আলফা এক্সোসোরিজ অ্যান্ড এগ্রো এক্সপোর্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালক সবাই এলাকার সুপরিচিত এবং ব্যাংকিং রেকর্ড ভালো। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্টে দেখা যায়, এসবই ভুল তথ্য। আরজান আলীর বয়স ৩৬ বছর। ২৬ বছর পর্যন্ত সে কোনো ব্যবসা করেননি। প্রতিবেদনের ৫.২ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত আরজান আলীর ব্যবসায়ের ধরন, প্রকৃতি, ব্যবসায়ের দায়-সম্পদ, আয়-ব্যয় বিবরণী, ভ্যাট ও আয়কর পরিশোধ সনদ ও সম্পদ বিবরণী সংক্রান্ত কোনো তথ্যই শাখা থেকে সংগ্রহ বা পরীক্ষা করা হয়নি। আরজান আলীর সিআইবি রিপোর্ট পরীক্ষা করে দেখা যায়, রেজাউল আলম নামের এক ব্যবসায়ীর মেয়াদি ঋণের গ্র্যান্টার ছিলেন আরজান আলী। ওই ঋণটিও ২০১৬ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৪ লাখ ৬১ হাজার টাকা স্থিতি, যা অশ্রেণিকৃত। তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়, সরেজমিন প্রকল্প পরিদর্শনকালে জানা যায়, আরজান আলী পারিবারিক ব্যবসার পাশাপাশি ইতিপূর্বে সাউথ বাংলা ব্যাংকের চেয়ারম্যান এসএম আমজাদ হোসেনের মালিকানাধীন ‘লকপুর’ গ্রুপে কর্মরত ছিলেন। তবে তার ব্যবসায়িক কোনো অভিজ্ঞতা নেই বলেই তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। কার্যপত্রের ৯.২ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মাহফুজা খানম রিশার নামে কোথাও কোনো দায়-দেনা নেই। সে হিসেবে তিনি কোম্পানির ৭৫ শতাংশ শেয়ারের অধিকারী। মাহফুজা খানম রিশার ব্যবসা সংশ্লিষ্ট কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতার প্রমাণ বহন করে না। তার সিআইবি রিপোর্ট পরীক্ষা করে দেখা যায়, রিশার নামে কোনো ঋণ নেই কিংবা আয়কর রিটার্ন দাখিল হয়নি। তার নামে কোনো ঋণ না থাকায় ও আয়কর রিটার্ন না থাকায় দায়-দেনা থাকার কথা নয়। রিশার বর্তমান বয়স মাত্র ১৯ বছর এবং পেশায় সে একজন ছাত্রী। কাজেই তার ব্যবসা সংশ্লিষ্ট পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকার কথা নয়। তার নামে ব্যাংক হিসাব নেই বলে যে তথ্য দেয়া হয়েছে তা সত্য নয়। তার নামে একটি স্কুল সঞ্চয়ী হিসাব রয়েছে বলে তদন্তে প্রমাণিত হয়। রিশার ই-টিআইএন নম্বর ১৬৬২৮৬২৮০৩৫৯ দেয়া হলেও তার জাতীয় পরিচয়পত্রের কোনো বিবরণ নেই। বস্তুত জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া ই-টিআইএন নিবন্ধন সম্ভব নয়। বিষয়টি কেন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ পর্যবেক্ষণ করলেন না বা কী কারণে এই গুরুত্বপূর্ণ বিচ্যুতি এড়িয়ে গেলেন তাও বোধগম্য নয় বলে উল্লেখ করা হয়। শাখা কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেল, রিশা সাউথ বাংলা ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান এসএম আমজাদ হোসেনের মেজ ভাই মো. রুহুল কুদ্দুসের মেয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, এই ধরনের বিপুল পরিমাণ ঋণ প্রস্তাব বিবেচনা বা অনুমোদন ও বিতরণের পূর্বে উল্লিখিত দালিলিক প্রমাণাদি সংগ্রহ ব্যতিরেকে শেয়ারহোল্ডারদের সামর্থ্য ও বিশ্বাসযোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতা যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যাচাই-বাছাই ব্যতিরেকে বড় অঙ্কের ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ করে শাখাটিকে বড় ধরনের ঝুঁকির সম্মুখীন করা হয়েছে বলে সন্দেহাতীতভাবে প্রতীয়মান হয়েছে। চিংড়ি প্রসেসিং ফ্যাক্টরি ও রফতানি ব্যবসা প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ২৫ শতাংশ কোম্পানির নিজস্ব অর্থায়নে সম্পন্ন করা হয়েছে, অবশিষ্ট কাজ দ্রুত করার জন্য চলমান রয়েছে বলে প্রত্যয়ন করা হয়েছে। ২৫ শতাংশ সম্পন্ন হলেও ১৩ কোটি ৫৩ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। আলফা এক্সোসোরিজ অ্যান্ড এগ্রো এক্সপোর্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালক যথাক্রমে চাকুরিজীবী ও ছাত্রী হওয়া সত্ত্বেও এই বিপুল পরিমাণ অর্থ কীভাবে নিজস্ব উত্স থেকে ব্যয় করলেন এ বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের উদ্রেক হলেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে প্রভাবিত হয়ে উত্স সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়েই শাখা ব্যবস্থাপনা ঋণ প্রস্তাব করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়েছে। আবেদনকারী ও সহোযোগী প্রতিষ্ঠানের আমদানি বা রফতানির কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। কার্যপত্রের ৫.১ উপ-অনুচ্ছেদে ‘প্রজেক্ট কস্ট’ অংশে বিদ্যমান কলাম ও তত্সহ উপ-অনুচ্ছেদে নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করা হয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পে স্থাপনতব্য অধিকাংশ যন্ত্রপাতি আমদানি করা হয়েছে এবং কিছু যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য এলসি স্থাপন করা হয়েছে মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। শাখা ব্যবস্থাপক ৩ মার্চে প্রকল্প পরিদর্শন প্রতিবেদনে প্রকল্পের অবকাঠামোর ৩০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে মর্মে প্রত্যয়ন করলেও সুনির্দিষ্টভাবে প্রজেক্ট ফাইল অনুযায়ী কোন কোন কাজের কতটুকু অংশ সম্পন্ন হয়েছে তা উল্লেখ করা হয়নি। এছাড়া নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পের স্থাপনতব্য অধিকাংশ যন্ত্রপাতি আমদানি করা হয়েছে মর্মে প্রত্যয়ন করা হলেও কোন কোন যন্ত্রপাতি আমদানি করা হয়েছে এবং কোন ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি স্থাপনপূর্বক আমদানি করা হয়েছে এমন কোনো তথ্য বা প্রমাণ শাখায় পাওয়া যায়নি। আমদানিকৃত যন্ত্রের তালিকা ও তার মূল্যমান সংক্রান্ত কোনো তথ্যও শাখায় পাওয়া যায়নি। রিপোর্ট পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার এক মাসের মধ্যে আমদানির উদ্দেশে প্রয়োজনীয় দালিলিক প্রমাণাদি সংগ্রহ ব্যতীত ‘প্রকল্পের অধিকাংশ আমদানি করা হয়েছে’ মর্মে শাখা ব্যবস্থাপক কর্তৃক যে প্রত্যয়ন করা হয়েছে (কার্যপত্রের উপ-অনুচ্ছেদ ৫.১) তা উদ্দেশ্য প্রণোদিত মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে। সরেজমিন পরিদর্শনকালে কিছু যন্ত্র নির্মাণাধীন প্রকল্পে থাকলেও এসব মেশিনারিজ আদৌ এ প্রকল্পের কি-না এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন ব্যতীত তাইওয়ান ও চীন থেকে ২৩ জুনে মোট প্রায় ১৮০ কোটি টাকার এলসি স্থাপন করা হয়। এর মধ্যে কোনোটার ইনভয়েসে এইচএস কোড নেই, কোনোটার ইউনিট প্রাইজ নেই। এছাড়া আমদানি তালিকায় যে মূল্য দেখানো হয়েছে তার দাম সঠিক কি-না সে বিষয়ে কোনো প্রমাণ দেখানো হয়নি। ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ২০ মার্চ ৫ শতাংশ মার্জিনে মূলধন যন্ত্রপাতি আমদানির উদ্দেশে ১৫ কোটি ৮ লাখ টাকার এলসি স্থাপনের অনুমোদন দেয়। কিন্তু অতিরিক্ত ২ কোটি টাকা অনুমোদনহীন এলসি স্থাপন করা হয়েছে। এ বিষয়ে শাখা ব্যবস্থাপক সন্তোষজনক কোনো জবাব দিতে পারেননি। যা গুরুতর অনিয়ম। চাইনিজ প্রতিষ্ঠান ‘ডালিয়ান বিংশান ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেডের নামে ক্রেডিট রিপোর্ট সংগ্রহ না করে এলসি স্থাপন করায় পরবর্তীতে এলসি মূল্য পরিশোধকালে বড় ধরনের অর্থ পাচারের আশঙ্কা রয়েছে বলে পরিদর্শন দলের নিকট প্রতীয়মান হয়েছে। রিপোর্টে দেখা যায়, প্রকল্পটি বাগেরহাট জেলার ফকিরহাটের কাটাখালি- মংলা মহাসড়কে অবস্থিত। রিশার নামে ফকিরহাটের নওয়াপাড়া মৌজার বিভিন্ন দাগে ৩২০ শতক জমি ব্যাংক শাখার অনুকূলে বন্ধককৃত। শাখা ব্যবস্থাপক কর্তৃক ৬ মার্চ প্রতি শতক জমির মূল্য সাড়ে ৮ লাখ টাকা ধরে ৩২০ শতক জমির দাম ২৭ কোটি ২০ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। তাত্ক্ষণিক বিক্রয়ের ক্ষেত্রে শতকপ্রতি ৭ লাখ ২২ হাজার ৫০০ টাকা ধরা হয় ফলে এর মোট মূল্য দাঁড়ায় ২৩ কোটি ১২ লাখ টাকা। কিন্তু ২০১৫ সালের মৌজাওয়ারি রেট পরীক্ষান্তে দেখা যায়, প্রতি শতক জমির বাণিজ্যিক মূল্য মাত্র ৬০ হাজার টাকা। সে হিসেবে মর্গেজ হিসেবে বন্ধক রাখা জমির মূল্য হয় ১ কোটি ৯২ লাখ টাকা। অবস্থানগত বিবেচনায় সম্পত্তির মূল্য সরকারি মৌজাওয়ারি রেট থেকে ১৩-১৪ গুণ বেশি ধরে সম্পত্তির মূল্যায়ন করা হয়েছে। পরিদর্শন দলের নিকট সম্পত্তির অতিমূল্যায়ন করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, লকপুর গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান একই ব্যক্তি হওয়ায় শাখা ব্যবস্থাপনা ও পরিচলনা পর্ষদকে প্রভাবিত করে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ওই অর্থ লকপুর গ্রুপে স্থানান্তর করা হয়েছে বলে পরিদর্শন দলের নিকট প্রতীয়মান হয়েছে। |