শিরোনাম: |
এসো হে বৈশাখ
|
সাদত আল মাহমুদ : এক সময় বাংলা নববর্ষ ছিল মূলত এই কৃষি সমাজের গ্রামীণ আয়োজন। কুটির শিল্প, হস্তশিল্প, কৃষিপণ্য আর ছেলে ভুলানো খেলা ও বিভিন্ন ধরনের খাবারই ছিল মেলার প্রধান উপকরণ। পরবর্তীতে কালের বিবর্তন এবং সময়ের প্রয়োজনের হাঁটি হাঁটি পা পা করে এই গ্রামীণ মেলা রাজধানীসহ দেশের সব ছোট-বড় শহরগুলোতেও পাকাপোক্ত জায়গা করে নিয়েছে। বাংলা নববর্ষ বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম ধারক ও বাহক। জাতি হিসেবে আমাদের রয়েছে হাজারো বছরের শিল্পের গৌরবময় ঐতিহ্য। মূলত বাঙালির ভাষা-সংস্কৃতির উপর পাকিস্তানি আগ্রাসনের প্রতিবাদে বর্ষবরণের এ আয়োজন শুরু হয় ১৯৬৭ সালে। এরপর থেকেই নিয়মিতভাবে রমনার বটমূলে সারদ-সেতার বাজানোর মধ্য দিয়ে নতুন বছরকে আমরা সকলেই আবাহন করে থাকি। বাংলা নতুন বছরকে আবাহন করার জন্য সব সময়ই এগিয়ে আসে ছায়ানট। মিছিলের আগে থাকা ছায়ানটের নেতৃত্বে আমরা সকলেই বর্ষবরণের সকল কার্য সমাধান করি। এরপর পহেলা বৈশাখের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য আয়োজন মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে এগিয়ে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ছাত্রছাত্রীরা। বাঙালি জাতির প্রাণের উত্সব পহেলা বৈশাখ। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই বাংলার নতুন বছরকে অনেক তৃপ্তি নিয়ে বরণ করে থাকে। ৩৬৫ দিন বাংলার সকল স্তরের মানুষ মুখিয়ে থাকে পহেলা বৈশাখকে বরণ করার জন্য। অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর যখন বাংলা নববর্ষ প্রতিটি বাঙালির ঘরের দরজায় কড়া নাড়ে, তখন সবাই খুশির বন্যার মধ্য দিয়ে বৈশাখকে বরণ করে। প্রতি বছরই সকল স্তরের মানুষ পহেলা বৈশাখকে নতুন রূপে বরণ করে নেয়। প্রতিবছরই বিশাল পহেলা বৈশাখের মিছিলে লক্ষ কোটি মানুষের সংযোজন ঘটে, কিন্তু কখনই এই বিশাল মিছিলের বিয়োজন ঘটে না।
পূর্বে পহেলা বৈশাখকে উপলক্ষ করে ঐদিন যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী বাড়ির সকলের জন্য ভালমন্দ খাবারের ব্যবস্থা করা হতো। মুরুব্বীরা বলতেন, বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিন ভালো-মন্দ খাবার খেলে সারা বছরজুড়েই কপালে ভালো খাবার জোটে থাকে। মুরুব্বীদের এই কথা কিছুটা হয়তো ঠিক অথবা ঠিক নয়। এই তর্কে আমরা নাই বা গেলাম। বিগত কয়েক বছর যাবত্ বাংলা নতুন বছরের শুরুর দিনে গ্রাম-শহর প্রায় সর্বত্রই মানুষের রুচি এবং চাহিদার পরিবর্তন ঘটেছে চোখে পড়ার মতো। এখন আমাদের সমাজের অনেকেই বিশেষ করে শহরে বসবাসকারী লোকজন ভালো খাবারের পাশাপাশি পানতা ইলিশের ব্যবস্থা করে থাকে। কেউ কেউ শুধু পানতা-ইলিশের আয়োজন করেই প্র-পহেলা বৈশাখের আনন্দ খুঁজে নেয়। নতুন বছরকে বরণ করার জন্য ঈদ, পূজা ও বড়দিনের মত বড়-ছোট সকলেই নতুন জামা-কাপড় পড়ে। বাংলা নতুন বছর উদযাপনের গায়ে থাকে বৈশাখী ছাপ। অন্যদিকে ঈদ-পূজা-বড়দিনের পোশাকে থাকে না ঈদ-পুজো-বড়দিনের ছাপ। বৈশাখের বাহারী পোশাক পরিধানের জন্য সংসারের কর্তাকে নতুন করে খরচের খাতা খুলতে হলেও অন্যদিকে পোশাক শিল্পের সাথে যারা জড়িত তাদের এ সময়ে পোশাক বেচা-বিক্রি বেড়ে যায়। এতে করে পোশাক শিল্পের সাথে জড়িত মহাজনদের পকেটে মুনাফার টাকা প্রবেশ করে। মহাজনদের পাশাপাশি দোকানের কর্মচারীরাও কয়েকটা টাকার মুখ দেখে বৈশাখের আনন্দটা ভাগাভাগি করে নেয়। দীর্ঘ এক বছর পর বাঙালির প্রাণের পহেলা বৈশাখ দরজায় এসে কড়া নাড়বে, অথচ কিছু খরচ হবে না, তা কি কখনো হয়! নতুন বছরকে বরণ করার জন্য না হয় কিছু খরচ হলোই, এটা আর এমন কি! বাঙালি খরচ করার ভয়ে কখনও পিছপা হন না। আগামীকাল কী খাবে বা কেমন করে দিন যাবে এটা নিয়ে আমাদের অনেকেরই কোনো রকমের বাড়তি চিন্তা-ভাবনা থাকে না। আজকে টাকা আছে, খরচের খাতা বড় করে মাসতি করে যাই। নববর্ষকে কেন্দ্র করে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীচক্র, বৈশাখের সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে অল্প টাকার জিনিস অনেক বেশি টাকায় বিক্রি করে মানুষের মনে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলে দেয়। এতে করে প্রতিটি মানুষকে আনন্দের পাশাপাশি কষ্টও পেতে হয় বহুগুণে। এ সময় ৬০০-৭০০ টাকার এক কেজি ইলিশ মাছ ২৫০০-৩০০০/- টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে। এখানে বলে রাখা ভালো, এই অসাধু ইলিশ মাছ ব্যবসায়ীদেরকে শিক্ষা দেয়ার জন্য আমরা সকলেই অন্তত ওই দিন ইলিশ মাছ বয়কট করতে পারি। ইলিশ মাছ দিয়ে পহেলা বৈশাখ পালন না করলে পহেলা বৈশাখে সামান্যতম প্রভাব পড়বে না। ওই দিন আমরা অন্যকিছু দিয়ে পহেলা বৈশাখ পালন করতে পারি। আমরা অনেকেই জানি, বাংলার প্রতিটি গ্রাম-গঞ্জে প্রায় মানুষই সকালে বা দুপুরে পানতা ভাত পিয়াজ-মরিচ-আলু ভর্তা দিয়ে খেয়ে থাকেন। আমরা শহরে বসবাসকারী ব্যক্তিগণ একদিনের জন্য গ্রামের ওই সব দরিদ্র মানুষদের দৈনন্দিন খাবারের তালিকার মেনু যেমন-পিয়াজ-আলু ভর্তা দিয়ে পানতা খেয়ে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করতে পারি। এতে করে যেমনি বৈশাখকে সম্মান দেখানো যাবে তেমনি ওই সব খেটে খাওয়া গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র মানুষদেরকে সম্মান দেখানো হবে। পহেলা বৈশাখের দিন বাংলাদেশের সমস্ত জায়গাতেই ব্যাপক লোক সমাগমের পাশাপাশি খুশির হাটও বসে চোখে পড়ার মতো। তবে রাজধানী ঢাকা শহরের চিত্রটা বাংলাদেশের অন্য যে কোন জায়গা থেকে ভিন্নতর। পহেলা বৈশাখের দিন ঢাকা শহরের প্রায় জায়গাই জনসমুদ্রে পরিণত হয়। এ সময় রাস্তা-ঘাটে মানুষের মিছিলের কারণে তিল ধারণের এতটুকু জায়গাও অবশিষ্ট থাকে না। বৈশাখের দিন দু’নয়ন মেলে দেখলে মনে হয়, গোটা ঢাকা শহরের মানুষ একত্র হয়ে কি যেন আনন্দের মাতম করছে। এ সময়ে পহেলা বৈশাখের গতিকে আরও ত্বরান্বিত করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা মঙ্গলযাত্রা নিয়ে বৈশাখের মিছিলে এসে সামিল হয়। মাথার ওপর প্রচণ্ড সূর্যের তাপ নিয়ে প্রতিটি মানুষ ঘেমে গোসল করে দিচ্ছে, তারপরেও যেন কারো মনে ও প্রাণে এতটুকু ক্লান্তির ছাপ নেই। সবাই দুর্বার গতিতে সবকিছু উপেক্ষা করে শুধু সামনের দিকেই এগিয়ে যায়। এ সময় চারুকলার ছাত্রছাত্রীরা মঙ্গলযাত্রার মধ্য দিয়ে দোয়েল পাখি, মোরগ, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, জাতীয় মাছ ইলিশের বানানো বিশাল বিশাল প্রতিকৃতি নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় প্রদক্ষিণ করে। এছাড়াও ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হাতে ফুলানো বেলুন, ডুগডুগি, ঢোল, একতারা, বাঁশিসহ অন্যান্য খেলনা নিয়ে মনের আনন্দে শহর প্রদক্ষিণ করে থাকে। তখন এ দৃশ্য দেখে মনে হয়, গোটা ঢাকা শহর নববর্ষের চাদরে নিজেকে খুশি মনে জড়িয়ে নিয়েছে। দীর্ঘদিনের ঢাকা শহরের পহেলা বৈশাখের উদযাপনের মাঝে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনারও জন্ম হয়েছে। বেশ কয়েক বছর পূর্বে রমনার বটমূলে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ওপর বোমা আক্রমনের ঘটনাও ঘটেছিল। এতে করে বেশকিছু লোক হতাহত পর্যন্ত হয়েছিল। অতীতের এই তীক্ত অভিজ্ঞতা থেকে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পহেলা বৈশাখের দিনটির ওপর নজরদারি বাড়িয়ে থাকে নজিরবিহীনভাবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তাটা এতটাই জোরদার হয় যে, ওই দিন ঢাকা শহরের চিত্রটা দেখলে মনে হবে, ঢাকা শহরকে নিরাপত্তার চাদর দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। পহেলা বৈশাখের দিন থেকে কয়েক দিনব্যাপী রমনা পার্কে মেলা বসে। এই মেলাতে ছোট-বড় সকলের জন্য হরেক রকমের জিনিসের পসরা বসে থাকে। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলেই মেলায় পসরা বসানো জিনিসের ক্রেতা। তবে ছোটদের জিনিসই মেলায় বেশি বিক্রি করতে দেখা যায়। বাচ্চাদের বিভিন্ন ধরনের খেলনার পাশাপাশি মুখরোচক নানা ধরনের খাবারও বিক্রি করে থাকে। যেমন- মুরালি, খুরমা, নিমকি, বাতাসা, সন্দেশ, জামাই পিঠাসহ নানা ধরনের খাবার মেলাতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন ধরনের সঙ্গীতের মাধ্যমে বাংলা নতুন বছরের শুরু হয় সকালবেলা রমনার বটমূল থেকে। সারাদিন নববর্ষকে বরণ করতে আসা মানুষ আনন্দের বন্যায় নিজেদের ভাসিয়ে রাতে যখন অনেকটাই ক্লান্ত হয়ে যায় তখনও মনের মণিকোঠায় আনন্দের রেস নিয়ে মনের খুশিতে বাড়ি ফিরে যায়। কাউকে দেখে মনে হবে না যে, এতটুকু বিরক্তির ছাপ তাদের চেহারায় দাগ কেটেছে। আমরা যখন কোনো কাজ খুশি মনে করি, সেখানে কোনো অবস্থাতেই বিরক্তিবোধ জন্মায় না। সে কাজটা যদি কঠোর পরিশ্রমের কাজও হয়, তাহলেও মানুষ সেটা আনন্দ নিয়েই করে থাকে। আমাদের এই সবুজ শ্যমল বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল একটি দেশ। আমাদের এই প্রাণপ্রিয় দেশটি এখনও হয়তো বেশকিছু সীমাবদ্বতা রয়েছে। ঈদ-পূজা-বাংলা নববর্ষের উত্সবে আমরা সকলেই আর্থিক দিক দিয়ে সঙ্গতি না থাকার কারণে খরচের খাতার ব্যারোমিটারটি সমানতালে উপর দিকে উঠাতে পারি না। কিন্তু সকলের মনে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ থাকে সমানভাবে। এতে আনন্দ প্রকাশের সামান্যতম কমতি থাকে না। আমাদের মাঝে যতই দুঃখ-বেদনা-কষ্ট, আর্থিক টানাটানি থাকুক না কেন, দেশ এবং দেশের বাহিরে যত বাঙালি আছি, সকলেই ভুবন কাঁপানো শব্দে বলি- এসো হে বৈশাখ, এসো এসো। লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, কলামিস্ট |