শিরোনাম: |
ভাসমান শিশুদের রক্ষায় করণীয়
|
মো. ওসমান গনি : আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত্। এ স্লোগানকে সামনে রেখেই আমাদের শিশুদের নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। তাদের আগামী ভবিষ্যতের জন্য সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। শিশুদের মাঝেই সুপ্ত থাকে বিভিন্ন প্রতিভা। আর তাদের এই প্রতিভাকে বিকশিত করতে হলে প্রয়োজন শিক্ষা। কারণ এই শিশুরাই একদিন হবে দেশ ও জাতির অগ্রনায়ক। তাই শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি কখনও উন্নতির চরম শিখরে আহরণ করতে পারে না। ছিন্নমূল অধিকার বঞ্চিত শিশুকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে তুলতে চাই উপযুক্ত শিক্ষা ও পরিবেশ। শিশুদের ছোটকাল থেকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে না পারলে আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্ম অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। কারণ একটি দেশের সুশিক্ষিত লোকেরাই একটি জাতি বা দেশকে সঠিক পথে পরিচালনা করার পরিকল্পনা বা সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে পারে। তাই প্রতিটি দেশই তার নাগরিকদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত শিক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে থাকে। আমাদের দেশেও সরকারিভাবে শিক্ষার জন্য বারবার বলা হলেও বাস্তবে তা কাজে আসছে না। তার কারণ আমাদের দেশ অর্থনৈতিকভাবে এখনও সচ্ছল হতে পারেনি।
যদিও বলা হয়ে থাকে দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ এগিয়ে যাচ্ছে দেশের একটি মহল। যাদের আছে ভুঁড়ি ভুঁড়ি তারাই এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। আমাদের দেশে যে সব ছিন্নমূল বা ভাসমান শিশুর রয়েছে তাদের খবর কে রাখে? তারা তো লেখাপড়া থাক দুরের কথা পেট পুরে দুবেলা খাবার খেতে পারে না। পরতে পারে না কোনো ভালো মানের কাপড়চোপড়। এর একটাই কারণ অভাব-অনটন। আমাদের দেশের বেশিরভাগ লোক এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। তাদের সংসারে অভাব অনটন লেগেই থাকে। তারা ছেলেমেয়েদের ঠিকমতো খাবার ও অন্যান্য মৌলিক অধিকারের সুযোগ-সুবিধা দিতে পারে না। ঠিক তখনই এসব শিশুরা জীবন বাঁচানোর তাগিদে সংগ্রামে নেমে বিভিন্ন কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ে। কখনও কুলি, হকার, রিকশা, শ্রমিক, ফুল বিক্রেতা, আবর্জনা সংগ্রাহক, হোটেল শ্রমিক, বুনন কর্মী, মাদক বাহক, বিড়ি শ্রমিক, ঝালাই কারখানার শ্রমিক ইত্যাদিসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে তারা নিয়োজিত হয়। যা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আমাদের অযত্ন, অবহেলা, উপযুক্ত পরিবেশ ও শিক্ষা সুযোগের অভাবে তারা যেন কখনই ঝরে না যায় সেদিকে আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি শহরে দেখা যায়, ০৫-১০ বছরের শিশুরা রাস্তার পাশে সংরক্ষিত ডাস্টবিন বা ময়লার ড্রেন থেকে পচা ময়লাযুক্ত খাবার নিয়ে খাচ্ছে, যেখানে সাধারণের চলাচলের অযোগ্য, সেখানে ক্ষুধার জ্বালায় নিমগ্নে খাবার খেয়ে যাচ্ছে অসংখ্য ছিন্নমূল শিশুরা। তারা যে খাবারগুলো ডাস্টবিন বা ড্রেন থেকে তুলে খাচ্ছে সে খাবারগুলো তাদের মতো কোনো না কোনো মানুষ ফেলেছে। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির রহস্য বোঝা বড় কঠিন। একটি শ্রেণির মানুষ খাবার খেয়ে ফেলে দিচ্ছে আবার আরেক শ্রেণির মানুষ সে খাবারগুলো ডাস্টবিন বা ড্রেন থেকে তুলে খেয়ে কোনো রকম জীবন বাঁচায়। আমাদের সমাজে এমন শিশুর সংখ্যা হয়তো স্বাভাবিক শিশুর সংখ্যার চেয়েও কম নয়। যারা নিজেদের চাহিদা মেটাতে অক্ষম, তারা আজ ঘর ছাড়া, আমাদের এই সমাজ তাদের নামের আগে পথকলি, ছিন্নমূল, ভাসমান ও টোকাই নাম দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তাদেরও তো একটা পরিচয় আছে, জন্মের সঙ্গে সঙ্গে তো আর তারা ছিন্নমূল, টোকাই হয়ে জন্মায়নি। তাদের ছিন্নমূল ও টোকাই বানানো হয়েছে। ছিন্নমূল হওয়ার পেছনে দায়ী কে হবে, আমাদের সমাজ ব্যবস্থা না রাষ্ট্র? অবাক লাগে এর দায়িত্ব আমরা কেউই নিতে চাই না। তাহলে এরা কারা? কি এদের পরিচয়? বাজার, মন্দির, টার্মিনাল, রেলস্টেশন, নগরীর ফুটপাতে অবাধে তাদের চলাফেরা দেখা যায়। দু’বেলা এক মুঠো ভাতের জন্য তারা চুরি, ডাকাতি, মাদকদ্রব্য সেবন, খুন করা, ভাসমান যৌনকর্মী হিসেবে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। অথচ তাদের তো একটা পরিচয় আছে, স্নেহভরা মায়ের কোল কি তার নিরাপদ আশ্রয়স্থল নয়। এদিকে আমরা প্রতিবছর ২ অক্টোবর পথশিশু দিবস, ৩০ সেপ্টেম্বর কন্যাশিশু দিবস, ২০ নভেম্বর ঘটা করে পালন করছি? এসব আমরা কার জন্য পালন করছি? সুধী সমাজের যারা বিবেক দুটো হাততালি পাওয়ার আশায় সেই ঘরের দুলালিদের নিয়ে ব্যানার ফেস্টুনের মাধ্যমে মিডিয়ায় প্রচার করে। বাহবাহও তারা কম পায় না। কিন্তু যাদের নিয়ে এ দিবস পালন তারা আজও ফুটপাতেই রয়ে গেল। তাদের জন্য কোনো ব্যবস্থা হয় না। আমাদের সমাজব্যবস্থা আজও কিছুই করতে পারছে না। আমাদের সমাজে কিছু সরকারি, কিছু বেসরকারি সামাজিক সংস্থা তাদের জন্য এগিয়ে আসলেও সুধী সমাজসহ বিত্তবানদের সহযোগিতা না থাকায় তাদের ভাগ্য আজও পরিবর্তন হচ্ছে না। ফলে আজ ছিন্নমূল বা ভাসমান শিশুরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অনাদরে অবহেলায় মানুষ হচ্ছে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিত্সা ইত্যাদি মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত এ দেশের দরিদ্র ও অসহায় শিশুরা। আজও তাদের রাস্তার পাশে আইসক্রিম খাওয়ার জন্য ঠিকই আহাজারি করতে হয়, এক মুঠো ভাতের জন্য জীবন যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয়। আর এ বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন অসামাজিক কর্মকাণ্ডে বিভিন্ন বয়সের শিশুরা জড়িয়ে পড়ছে। ফলে আমাদের আগামীর পথচলার হাতিয়ার সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে না। প্রশ্ন আজ একটাই তাহলে আমরা কাদের নিয়ে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখব, স্বপ্ন যেখানে ঘূর্ণায়মান লাটিম। আসলে আমরা স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছি। এখন শুধু অন্যের স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি। আসুন না আমরা নিজেই নিজেরা স্বপ্ন দেখি, স্বপ্ন দেখি ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার। যেখানে আমাদের চলার পথে ছিন্নমূল শিশু, টোকাই বা পথহারা নামে কোনো শিশু থাকবে না। নিজেদের সামান্য দু’মুঠো ভাতের জন্য অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হতে হবে না, মানুষের কাছে হাত বাড়াতে হবে না। আমরা স্বপ্ন দেখি, তাদেরও স্বপ্ন দেখায়, তাদেরও বাঁচার সুযোগ করে দিই। তাদেরও যে বাঁচার অধিকার আছে। আমাদের বিবেক, সেটা আজ বাধাগ্রস্ত। তারা নিজেদের সমাজব্যবস্থা থেকে বাইরে এসে কিছুই করতে পারছে না। ফলে আমাদের যুব সমাজ পথহারা বিবেকহীন মানুষে পরিণত হচ্ছে। এই নিয়ে সমাজ প্রতিষ্ঠা, সুন্দর সমাজ গড়া সম্ভব না। আমাদের দেশের ছিন্নমূল বা ভাসমান শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত্ গড়ে তুলতে হলে আমাদের সবারই এগিয়ে আসতে হবে। এলাকাভিত্তিক যে সব ছিন্নমূল বা ভাসমান শিশু রয়েছে তাদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হলে স্ব-স্ব এলাকার বিত্তবান লোকদের উদ্যোগী হতে হবে। দেশের শহর, বন্দর, গ্রামসহ যেখানে এসব শিশুরা রয়েছে তাদের সাহায্যর্থে সরকারের পাশাপাশি এলাকার বিত্তবান, ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের ভাসমান শিশুদের পুনর্বাসন করা আমার ও আপনার সকলের দায়িত্ব। এসব শিশুদের শিক্ষার বাইরে রেখে দেশকে কখনও সামনের দিকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব না। দেশের প্রতিটি নাগরিক সুশিক্ষায় শিক্ষিত হলে দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দেশের প্রতিটি ভাসমান শিশু শিক্ষিত হলে তাদের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন দ্রুত গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। কর্মসংস্থানের জন্য সরকারের পাশাপাশি দেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি, বেসরকারি সাহায্যকারী সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষা দেশের প্রতিটি নাগরিকের অধিকার। ভাসমান শিশুদের সেই অধিকার আদায়ে আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। লেখক: কলাম লেখক |