শিরোনাম: |
সড়কে রক্তপাত কি বন্ধ হবে না?
|
মীর আবদুল আলীম : সড়কে মৃত্যু মিছিল থামছে না। আমরা সচেষ্ট নই বলেই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে তো ঘটছেই। সংশ্লিষ্টরা কি করছেন এ প্রশ্ন থেকেই যায়? যেদিন লিখছি (২৭ মার্চ), সেদিন দেশের একটি জাতীয় দৈনিককের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, যন্ত্রদানব এবং চালকের বেপরোয়া গতি ৪৫ দিনে ৩১৩ জন মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে। এর প্রকৃত সংখ্যা নাকি আরও বেশি। এক অল্প সময়ে এত মানুষের মৃত্যু ভাবা কি যায়? এ মৃত্যু কেবল ঐ পরিবারগুলোরই ক্ষতি নয়, এটি জাতীয় ক্ষতি ধরে নিয়ে সরকারকে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সচেষ্ট হতে হবে। পত্রিকাতেই দেখলাম সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কঠোর আইন হচ্ছে, এবং খসড়া অনুমোদন হয়েছে। আইন তো আগেও ছিল। কতটা প্রয়োগ করেছে সরকার? বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্টরা নড়েচড়ে বসেন, হায়হুতাশ করেন, আইনের কথা ভাবেন। কিন্তু কিছুই হয় না বলেই তো দেখছি দীর্ঘদিন। যেভাবে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে তাতে সরকারকে আর গাছাড়াভাব দেখালে চলবে না। আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের নীতিনির্ধারক, চালক, পরিবহনকর্মী, যাত্রী এবং পথচারীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। ২৬ মার্চ সকালে ছোট ছেলেটা নাস্তার টেবিলে পদ্মা সেতুর কাজ সম্পর্কে বলছিল। পদ্মা সেতুর কাজের গতির খবরাখবর আমার কাছে আছে, তবু বললাম, আজই আমরা পদ্মা সেতুর কাজ দেখতে মাওয়া ঘাট যাব। তাকে সচোক্ষে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর কাজ দেখাবো বলেই এমন উদ্যোগ নিলাম। দুই ছেলে আর স্ত্রীও রাজী হলেন। ১০টার মধ্যেই রওনা হলাম আমরা। প্রাইভেটকারে বসেই পত্রিকার অনলাইগুলোতে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম। চুয়াডাঙ্গায় সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩ জনের মৃত্যু খবরে মনটা বিষণ্ন হয়ে উঠলো। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়েই ভাবতে থাকলাম সারাটাপথ।
পথ চলতে গিয়ে দেখলাম চালকরা সহনশীল নন। এমনকি আমার ড্রাইভার সাহেবও। গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণে রেখে, দূরত্ব বজায়ে চলে না কেউ। অহেতুক ওভারটেকিং হরহামেশাই করে চালকরা। আমার চালকও তাই। এক পর্যায়ে দুটি গাড়ি গতি নিয়ে ওভারটেক করছে, আমার গাড়িও ছুটছে তাদের পেছনে। ড্রাইভারকে থামিয়ে দিয়ে বললাম এমন ওভারটেকিংয়েই দেশে মানুষ মরছে বেশি। সড়কে এ নিয়ম যদি চালকরা মেনে চলে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা একে বারেই কমে আসবে। এ বিষয়ে গবেষণা কাজে যুক্ত হয়ে দেখেছি, প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে ওরাটেংয়ের সময় সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা এবং হতাহতের ঘটনা ঘটে। চুয়াডাঙ্গায় সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩ জনের মৃত্যুও ঘটনায় সারাদেশে হৈ চৈ পরে গেছে। ক’দিন এনিয়ে হৈ চৈ আরও হবে। মন্ত্রণালয়েও আইন পাসের কাগজপত্র ঠিকঠাকের কাজ চলছে। বুকে হাত রেখে বলতে পারি কিছুই হবে না। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকেই এমন কথা বলছি। এভাবে চলে না। চলতে দেয়া যায় না। সড়ক ও সেতুমন্ত্রী কিছু একটা করুক আমরা তা চাই। তিনি সব কিছুতেই বেশ দক্ষতা দেখিয়ে দেশবাসীর দৃষ্টিতে এসেছেন। আমরা মনে করি তিনি আরও সচেষ্ট হলে সড়ক দুর্ঘটনা কমে আসবে। পৃথিবীর সব দেশেই কমবেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু এভাবে? মৃত্যু পরোয়ানা হাতে নিয়েই তবেই আমাদের ঘর থেকে বেরুতে হয়। ঘরে ফিরে আসার নিশ্চয়তা কারো নেই। এমন অস্বাভাবিক মৃত্যু কি মেনে নেয়া যায়? কোন সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্টে এমনটি কাম্য হতে পারে না। আমাদের দুরভাগ্য প্রতিদিন এক অনভিপ্রেত সড়ত দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে চালকরা আর তা রোধে ব্যর্থ হচ্ছি আমরা। আইন আছে আইন প্রয়োগ হচ্ছে কি? পাশের দেশ ভারতসহ সারা বিশ্বে সড়ক দুর্ঘটায় দায়ীদের বিচার হয়। বাংলাদেশে তেমন হয় না। তারেক মাসুদ-মিশুক মুনিরদের ছাড়া আর কোনটাই অন্তত আমার মনে পড়ে না। এদেশে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়িদের বিচার করলেই সড়ক অচল করে দেয়া হয়। ক’দিন আগেও হয়েছে। আবার তাতে নাকি কোন মন্ত্রীর সায়ও ছিল। এই তো বাংলাদেশ! আমরা এখানে কি আশা করতে পারি। ৪৫ দিনে ৪১৩ জন মানুষ দেশ অহেতুক জীবন দেবে আর তাদের জীবনের মূল্য শূন্য হবে তা কি করে হয়। আমি মনে করি, এমন অবস্থায় সরকারের চুপচাপ বসে থাকা অন্যায়। সরকারের মন্ত্রী-আমলা সবাইকে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সড়কে নেমে পড়া উচিত্। কখনো কখনো সড়ক দুর্ঘটনার ব্যাপারে সজাগ হয় প্রশাসন, তাতে ভালো লাগে। সেদিন বেশ কয়েকটি দৈনিকে একটি খবর বেশ ফলাও করে ছাপা হয়েছে। এর একটির শিরোনাম এমন ‘গাড়ির চালক ও মালিককে খুঁজছে পুলিশ’। তারা যাতে পালাতে না পারেন, এ জন্য দেশের সব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে ইমিগ্রেশন পুলিশকে চিঠি দেয়া হয়েছে। বোধ করি ঐ গাড়ির মালিক ও চালক ছাড় পাবে না। এমন সংবাদ পড়ে খুব ভালো লাগলো। যেভাবে দেশে গাড়ির চাকায় মানুষ মরছে তাতে এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। কয়েক মাস আগে মিরপুরের শেওড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডের সামনে গাড়িচাপায় মারা যান কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মচারী আতাউর রহমান (৭৮) ও তার স্ত্রী রওশন আরা বেগম (৬০)। এ ব্যাপারে গাড়ির চালক নাসিফ খান ও তার বাবা গাড়ির মালিক আশিকুর রহমানকে গ্রেফতার করতে পুলিশ বেশ মরিয়া হয়ে উঠেছে। ঐ দম্পতির নিহত হবার ঘটনায় গাড়ির চালক এমনকি গাড়ির মালিকের সাজা হোক এটা আমরা চাই। এভাবে অপরাধী গাড়ির মালিক আর চলককে পুলিশ খুঁজতে শুরু করলে বোধ করি ২/১ মাসের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা কমে আসবে। চলকরা রাস্তায় সাবধানে গাড়ি চালালে দেশবাসীও অক্কা পাওয়ার হাত থেকে বেঁচে যাব। সড়ক দুর্ঘটনায় নামিদামি কেউ মারা গেলেই এমন হম্বি-তম্বি হয়। আইনের আওতায় আসে চালক-মালিক। এমন যদি সব ক্ষেত্রে হতো। সড়ক দুর্ঘটনা একেবারে কমে আসতো। ধন্যবাদ পেত সরকার। সড়ক দুর্ঘটনা একেবারে রোধ করা যাবে না। তবে এর হার কমিয়ে আনা অতি সহজ। ঐ যে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা দম্পতির হত্যার দায়ে চলক আর মালিককে যেভাবে দাবড়ানো হচ্ছে তা সব ক্ষেত্রে হলেও চালকরা রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে একটু সাবধানই হবেন বটে। মালিকরাও হেলপারের হাতে গাড়ির চাবি তুলে দিতে সাহস পাবেন না। তাতো আর হচ্ছে না। হলেও কবে হবে তা অনিশ্চিত। সড়ক দুর্ঘটনা এ যেন আমাদের ললাটের লিখন। দুর্ঘটনাকে ভাগ্য হিসেবেই মেনে নিচ্ছি আমরা। এখন কোন পরিবারে সদস্য সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে খুব একটা মামলা-মোকদ্দমায় যায় না। বিচার হয় না; গিয়ে কি লাভ? দু-দশ জন মারা গেলে নরহন্তারক গাড়ির চালক আর মালিককে ধরতে এমনভাবে দেশের সব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে ইমিগ্রেশন পুলিশকে চিঠি দেয়া তো দূরের কথা প্রশাসনের সহায়তায় খুনিচালক ঐদিনই সড়ক-মহাসড়কে গাড়ি নিয়ে দাবড়ে বেড়ানোর সুযোগ পায়। এজন্য হয়তো তাদের ১০/২০ হাজার টাকা নগদি খরচ হয়। সপ্তাহখানেক আগে আমার অতি স্নেহের এক ছোট ভাই জিটিভির নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি আশিকুর রহমান হান্নানের জেএসসি পরীক্ষার্থী এক ভাতিজি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের রূপগঞ্জের বরপায় ঘটে এ দুর্ঘটনা। ফকির ফ্যাশনের একটি গাড়ি রাস্তা ছেড়ে ফুটপথে এসে তাকে চাপা দেয়। রাস্তায় আইল্যান্ড এড়িয়ে চলতে গিয়ে দ্রুতগামী গাড়িটি ঐ শিক্ষার্থীর উপর উঠে তার জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দেয়। সাংবাদিক আশিক অত্যন্ত সচেতন একজন ব্যক্তি। লেখালেখির পাশাপাশি সামাজিক কর্মকাণ্ড করেন। মাদকের বিরুদ্ধে লড়ছেন দীর্ঘদিন ধরে। আমি যতদূর জানি এ ঘটনায়ও মামলা হয়নি। ফকির ফ্যাশনের ঐ খুনে গাড়ি ঐ রাস্তায় বীরদর্পে দাবড়ে বেড়াচ্ছে। এমন অপরাধ করে চালকও বহাল তবিয়তেই আছেন। ফকির ফ্যাশন কর্তৃপক্ষও ঐ চালকের কোন শাস্তির ব্যবস্থা করেনি বলে জনতে পেরেছি। হয়তো কিছু দিন গড়ালে তার প্রমোশনও হয়ে যাওয়া বিচিত্র নয়! এইতো পরিস্থিতি! শাস্তি হয় না খুনি চলকের। তাহলে রাস্তার রক্তপাত বন্ধ হবে কি করে? পাঠক, আপনাদের জানা প্রয়োজন আছে, বিশ্বের অত্যধিক সড়ক দুর্ঘটনাপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। নেপাল, মালয়েশিয়ার মতো এত পাহাড় পর্বত নেই তবু দুর্ঘটনা ঘটছে তো ঘটছেই। বর্তমানে দেশে সড়ক দুর্ঘটনার এই মাত্রা ভয়াবহ, যা ক্রমে বাড়ছে। প্রতিদিনের এসব দুর্ঘটনায় আহত-নিহত হচ্ছে অসংখ্য মানুষ, যারা আমাদেরই পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন কিংবা পরিচিত জন। সড়ক দুর্ঘটনায় পরিবহন শ্রমিকরাও আহত-নিহত হচ্ছেন, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মালিক শ্রেণিও; যা প্রত্যাশিত নয়। বিশ্বব্যাংক, দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট, বুয়েট এবং বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ১০-১২ হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করছে ১৮-২০ হাজার মানুষ এবং আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকার; যা দেশের আর্থসামাজিক সঙ্কটকে তীব্রতর করে তুলছে। বছরে এত বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতি একমাত্র বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া অন্য সব দুর্ঘটনা মিলিয়েও ঘটে না। বিষয়টি জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। অথচ এ বিষয়ে কার্যকর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করছে না সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল, সরব হচ্ছে না নাগরিক সমাজও। দেশে খুব বড় ধরনের সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিসহ নাগরিক সমাজ তত্পর হয়ে ওঠে। দু-একদিন পর আবার সবাই ভুলে যায় এবং স্বাভাবিকভাবেই দুর্ঘটনাগুলো ঘটতে থাকে। বিষয়টি এ রকম দাঁড়িয়েছে যে, প্রতিদিন ১৫-২০ জনের মৃত্যু আদৌ কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। কোনো দুর্ঘটনায় রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বা সেলিব্রেটি আহত-নিহত হলে প্রায় সবাই রাস্তায় নেমে পড়ি, আন্দোলনও দানা বাঁধে, তারপর ওই একই ঘটনা, সবকিছু চুপচাপ। দেশের কীর্তিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও বিশিষ্ট সাংবাদিক মিশুক মুনীরের মৃত্যুর পর সড়ক দুর্ঘটনাবিরোধী আন্দোলনে গোটা দেশ উত্তাল হয়ে উঠেছিল, কিন্তু তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, প্রভাবশালী ও পেশাজীবী শ্রেণির কোনো মানুষ আহত-নিহত হলে সরকারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে, কিন্তু প্রতিদিনের দুর্ঘটনায় যে অসংখ্য সাধারণ মানুষ আহত-নিহত হচ্ছে, তাদের চিকিত্সা, এমনকি মরদেহ বহন কিংবা দাফনেও তেমন সহায়তা করে না কেউ। কত পরিবার একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষকে হারিয়ে পথে বসেছে, কত সন্তানের পড়ালেখা বন্ধ হয়েছে, কত মানুষের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। আর আহত হয়ে পঙ্গু মানুষের অবহেলিত কষ্টকর জীবনের কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। সড়ক দুর্ঘটনার পর একটি মামলা হয় (অনেক সময় তাও হয় না), তার পর সেই মামলার কোনো অগ্রগতি তো দূরের কথা, এর হদিসই থাকে না। অধিকাংশ দুর্ঘটনার পর চালক-হেলপার পালিয়ে যায়। কীভাবে পালায়, কেন গ্রেফতার হয় না, তা আমরা সবাই কমবেশি জানি। তবে গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তি আহত-নিহত হলে চালক গ্রেফতার হয়। তার পর সেই চালকের মুক্তির দাবিতে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা আন্দোলন করেন এবং চালক যথারীতি মুক্তি পায়। এই হলো বাস্তবতা, এটা কোনো সভ্য সমাজে চলতে পারে না। দেশের সড়কের ধরন ও ব্যবস্থাপনা দুর্ঘটনার জন্য অনেকাংশে দায়ী, বিশেষ করে নকশা ও কাঠামোগত ত্রুটির কারণে সড়কের অনেক স্থান দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা হিসেবে পরিণত হয়েছে, যা সঠিকভাবে সংস্কার বা মেরামত করা হয় না। রাজধানীর ফুটওভার ব্রিজগুলোর অধিকাংশই সঠিক জায়গায় নির্মিত হয়নি এবং এগুলো ব্যবহার উপযোগীও রাখা হয় না। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই ফুটওভার ব্রিজের তেমন সুফল পাওয়া যায় না। মহানগরীর যেসব স্থানে ত্রিমুখী বা চতুর্মুখী সড়ক রয়েছে, সেসব স্থানে অদ্যাবধি বহুমুখী ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা হয়নি। যেমন- শাহবাগ, মত্?স্য ভবন, পুরনো পল্টন, মালিবাগ মোড় ইত্যাদি। এসব স্থানে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে, মৃত্যু হচ্ছে বহু মানুষের। যারা এ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছেন, তারা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার তহবিল সংকটের কথাও বলা হয় সবসময়। দেশের সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে বিআরটিএ নামক একটি প্রতিষ্ঠান আছে। প্রতিষ্ঠানটি জনবলস্বল্পতা ও দুর্নীতিসহ নানা সংকটে নিমজ্জিত। ফলে সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাপনায় সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না কোনোভাবেই। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে ২১ লাখ মোটরযান চলাচল করে। অথচ বৈধ ড্রাইভার আছে মাত্র ১৪ লাখ। বাকি ৭ লাখ মোটরযান চলছে অবৈধ ও অনভিজ্ঞ ড্রাইভার দ্বারা। কী অদ্ভুত ও ভয়াবহ ব্যাপার! এছাড়া সড়ক-মহাসড়কে চলাচলকারী অধিকাংশ মোটরযানই ফিটনেসবিহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ। এসব মোটরযানের বিরুদ্ধে কার্যকর উদ্যোগ ধারাবাহিকভাবে গ্রহণ করা হচ্ছে না পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের বিরোধিতার কারণে। বিষয়টি রামরাজত্বের মতো। সবসময় বলা হয়, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে জনসাধারণকে সচেতন করতে হবে। কিন্তু বাস-বতা হলো, কেবল সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাবে দুর্ঘটনা ঘটছে না; বরং অনেকগুলো কারণের এটি একটি মাত্র। এক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতা সৃষ্টি করতে হবে জনসাধারণসহ পরিবহনের মালিক-শ্রমিক, সড়ক বিভাগের সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে। একই সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বিচার ও শাস্তি প্রদানে দেশে বিদ্যমান আইনের সংস্কার করতে হবে ন্যায্যতার ভিত্তিতে। পরিবহনের মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করে তাদের বোঝাতে হবে- সড়ক দুর্ঘটনা সবার জন্যই ক্ষতিকর। এজন্য প্রয়োজন সড়ক দুর্ঘটনাবিরোধী একটি ব্যাপকভিত্তিক সামাজিক আন্দোলন। এক্ষেত্রে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার বিকল্প নেই। অবাক বিষয়, এত ব্যাপক সড়ক দুর্ঘটনাপ্রবণ দেশে জনসাধারণসহ সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সরকারের তেমন কোনো তহবিল নেই। অথচ অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেও যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ রাখা হয় প্রতি বছর, যার অনেকটাই অপচয় হয়। বিষয়টি সরকারকে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। দেশে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বেশকিছু সংগঠন কাজ করছে। তবে পরিস্থিতির বাস্তবতায় এ রকম বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে খুব বেশি অগ্রগতি সম্ভব নয়; বরং এভাবে চলতে থাকলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। তাই কালক্ষেপণ না করে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে একটি সমন্বিত কর্মকৌশলের অধীনে দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই কার্যক্রম শুরু করতে হবে। এক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন সামাজিক ও নাগরিক সংগঠন, সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী, চিকিত্সক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, আইনজীবী, জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ের পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ে একযোগে কাজ করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে নিম্নলিখিত প্রস্তাব বাস্তবায়ন জরুরি: ১. পরিবহন শ্রমিকদের নিয়োগপত্র প্রদান, ইউনিফর্ম প্রবর্তন, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্টকরণ, কাউন্সিলিং ও টার্মিনালে বিশ্রামাগার তৈরি। ২. বিআরটিএকে দুর্নীতিমুক্ত ও শক্তিশালীকরণ। ৩. ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে ন্যূনতম বয়স এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ ও বাস-বায়ন। ৪. সড়ক দুর্ঘটনা-সংক্রান্ত বিদ্যমান আইনের সংস্কার সাধন এবং পৃথক আদালত প্রবর্তন। ৫. পরিবহনের চাঁদাবাজি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ। ৬. যাত্রী বীমা চালু। ৭. জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে বিভাজন গার্ডার নির্মাণ। ৮. মহাসড়কে ওয়েট লিফটিং স্টেশন নির্মাণ করে ওভারলোডিং ও স্পিড ক্যামেরা স্থাপন করে গতিসীমা নিয়ন্ত্রণ। ৯. মহাসড়কে নির্দিষ্ট দূরত্ব অনুযায়ী জরুরি চিকিত্?সা কেন্দ্র নির্মাণ। ১০. হাইওয়ে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস ও হাইওয়ে পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধি। ১১. মহাসড়কের ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকগুলো সংস্কার, এসব স্থানে সাইনবোর্ড স্থাপন ও তোরণ নির্মাণ নিষিদ্ধকরণ এবং যথাস্থানে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ। ১২. পাঠ্যপুস্তকে সড়ক দুর্ঘটনাবিষয়ক গল্প বা প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্তকরণ, সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রবেশ মুখে সচেতনতামূলক সাইনবোর্ড স্থাপন। ১৩. সব কর্মক্ষেত্রের দৃশ্যমান স্থানে সড়ক দুর্ঘটনাবিষয়ক সাইনবোর্ড/পোস্টার প্রদর্শন। ১৪. দক্ষ চালকদের জন্য জাতীয়ভিত্তিক পুরস্কার প্রবর্তন, যাতে তারা সামাজিকভাবে মর্যাদাবোধ করেন। এতে অন্য চালকরাও এ ধরনের পুরস্কারপ্রাপ্তির জন্য দুর্ঘটনামুক্ত পরিবহন চালনায় উত্সাহিত হবেন। উল্লিখিত, আইনের সঠিক প্রয়োগ এবং উপরোক্ত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করা হলে দেশে সড়ক দুর্ঘটনার মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে আসবে বলে আমরা মনে করি। তাতে বহু মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষা হবে। তাই নাগরিক সমাজকে এ বিষয়ে একটি শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে এবং সরকারকে সমন্বিত ও টেকসই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানাই। বিষয়টি এখন সময়ের দাবি। লেখক: কলাম লেখক। |