শিরোনাম: |
শর্ট-কাটের বিড়ম্বনা
|
বাদল বিহারী চক্রবর্তী : মিজি সাহেবের অফিসের বড় সাহেব সব কিছুতেই শর্ট-কাট পছন্দ করেন। বেশি বর্ণনামূলক কোন লেখা, দফতর-আদেশ কিংবা, পরিপত্র ইস্যু করা তার কাছে সাংঘাতিক বিরক্তিকর ও অপছন্দের। একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের ‘হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা’- তুষার মিজি। বলতে গেলে, অফিসের সিংহভাগ কাজ-কর্ম করতে হয় মধ্য বয়সী এই মানুষটিকে। মিতভাষী, শান্ত প্রকৃতির মিজি সাহেব পারত পক্ষে তার সহকর্মীদের বেশি দায়িত্ব না দিয়ে বড় ভাইয়ের মতো নিজের কাঁধেই রাখেন। তাই, কোন অভাব-অভিযোগ বা, চাওয়া-পাওয়ার মনোবাঞ্ছা নিয়ে বড় সাহেবের কাছে না গিয়ে সহকর্মীরা তাদের সিনিয়র পার্শ্তোপবিষ্ট ব্যক্তিত্ব, তুষার মিজির কাছেই গিয়ে থাকেন। কিন্তু হলে কি হবে, বড় সাহেব তার সাব-অর্ডিনেট স্টাফের সঙ্গে সর্বক্ষণ খিটিমিটি মেজাজে ছড়ি ঘুরিয়ে থাকেন। বিশেষ করে, তুষার মিজির ওপর তিনি এমনই রক্তচক্ষু দেখান যে মিজি সাহেব সারাক্ষণই তার ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকেন। অথচ নিজের দায়িত্বের চেয়ে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন মিজি; যে কারণে অফিস টাইম শুরু হওয়ার আধঘণ্টা পূর্বে অফিসে এলেও শেষ সময়ের পরও দীর্ঘক্ষণ কাজ করেন তিনি নিষ্ঠা ও সততায়। পক্ষান্তরে, বড় সাহেব নিজের দায়িত্ব তো পুরোপুরি করেনই না, উপরন্তু খিটিমিটি মেজাজ দেখিয়ে এক উটকো ও অপ্রয়োজনীয় চাপে রাখেন সাব- অর্ডিনেটদের।
শাম লাহা, গনি রুদ্র ও চোকদার রফিক, এ তিন জনই তুষার মিজির অপেক্ষাকৃত তরুণ ও জুনিয়র সহকর্মী। মতিঝিল হেড অফিস, যার শাখা অফিস হিসেবে গুলশানের একটি দ্বিতল বাড়ি ভাড়া নিয়ে বড় সাহেব, ম্যাসেঞ্জার আর মিজিরা চার জনের সমন্বয়ে মোট ছয় লোকবলের তাদের এ ছোট্ট আঞ্চলিক অফিসের কার্যক্রম চলে। অফিসের ওপর তলার পুরোটাই বড় সাহেবের চেম্বার ও বিশ্রামের পার্শ্বকক্ষ এবং নিচ তলায় জাবতীয় দলিল দস্তাবেজের আলমারি সহ মিজি সাহেবদের টেবিল চেয়ার সম্পন্ন কর্তব্য পরিপালনের স্থান। মাত্র মাস ছয়েক হল বড় সাহেব এই আঞ্চলিক অফিসে ট্রান্সফার্ড হয়ে এসেছেন। শোনা যায়, কর্তব্যে অবহেলা আর তিরিক্ষি মেজাজের কারণেই নাকি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাকে হেড অফিস থেকে এখানে পাঠিয়েছেন। এখানে আসার চতুর্থ দিবসেই তিনি মিজি ও অন্যান্য সহকর্মীদেরকে নিজ চেম্বারে ডেকে নিয়ে এক প্রকার শাসনের সুরেই বলে দিলেন, ‘ শুনুন মিঃ তুষার, আমি যখন এখানে জয়েন করেছি, তখন হয় আপনারা সোজা পথে চলবেন, না হয় অন্যত্র চলে যাবেন। আর কোন খাতা-পত্রে আমি বেশি লেখা পছন্দ করিনা। পুরোনো পণ্ডিতদের ধ্যান ধারণার বিস্তারিত লেখার দিন ভুলে যান। সব কিছু শর্ট-কাট, মানে সংক্ষিপ্ত আকারে লেখবেন। বেশি লেখা পড়তে আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। মনে রাখবেন, এটা আমার আদেশ। এর ব্যত্যয় ঘটলে কাউকে আমি কঠোর পানিশমেন্ট দিতে ছাড়বোনা। মনে থাকে যেন, শর্ট-কাট। সাহেবের এমন কড়া নির্দেশ মাথায় নিয়ে সেদিন সাব-অর্ডিনেটরা নিজ নিজ টেবিলে এক রকম ভীত সন্ত্রস্ত মন নিয়ে বসে রইলেন। কোন কাজে যেন তাদের মন লাগাতে পারছিল না। প্রথম সপ্তাহের কর্মদিবসগুলো পার হয়ে গেল এক রুদ্ধশ্বাস সময় ও পরিবেশের মধ্যেই, বড় সাহেব আসার পর। আবার দ্বিতীয় সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস রবিবার। অফিষ চলাকালীন কোন এক সময় তুষার মিজির টেবিলের কাছে এসে মিজি ও মিজির সহকর্মীদের মধ্যে কথা হচ্ছিল। তাদের আলোচনার মূল বিষয় ছিল বড় সাহেব। শাম লাহা অনেকটা নিচু গলায় বলেন, ‘আচ্ছা তুষার ভাই, বড় স্যারকে আপনার কেমন মনে হয়’? মি. লাহার কথা শোনে মিজি কাজে রত রেজিষ্টার হতে মুখ তোলে নিজের চশমার ওপর দিয়ে কিছুটা বাঁকা চোখে বললেন, ‘দেখতেই তো পাচ্ছ। আরও কিছুদিন যাক, দেখি না কি অবস্থা দাঁড়ায়’। -না ভাই, মর্নিং শোজ দ্য ডে। আমি যা বোঝার এই ক’দিনেই-, লাহার কথা শেষ না হতেই গনি রুদ্র যেন লাহার মুখ থেকে কথাটা কেড়ে নিয়েই বলে ফেলে, ‘এই স্যারের আন্ডারে কাজ করে শান্তি পাওয়া যাবে না তুষার ভাই’। -‘দাদা আর গনি সাবের ধারণার সঙ্গে আমিও এক মতো’ বলতে বলতে চেয়ার টেনে আরো কাছে এসে বললেন চোকদার রফিক। -‘আরে ভাই, আমি কি আর বুঝি না? এত বছর ধরে এখানে কাজ করছি, অথচ দ্যাখো, পূর্ববর্তী স্যার আমাদের কত কো-অপারেটিভ ছিলেন। যে কোন ব্যাপারে আমার সিদ্ধান্তই ছিল উনার কাছে গ্রহণযোগ্য’।- কথাগুলো বলে রেজিস্টারের পাতা উল্টিয়ে যাচ্ছিলেন তুষার মিজি। -‘এর থেকে পরিত্রাণ, মানে নিঃশঙ্কচিত্তে কাজ করে যাওয়ার উপায় কি? -শাম লাহা মিজির দিকে মুখ রাখলেন। -‘আরে বাদ দাও পরিত্রাণ। উনি কী আর করতে পারবেন? আমরা যে যার দায়িত্ব সময় মতো সুষ্ঠুভাবে পরিপালন করলে উনার কিছুই করার থাকবে না’। -তুষার মিজির আশ্বাস বাণী। জবাবে আবার মি. লাহা বলেন, ‘কিন্তু, স্যার যে বললেন সব কিছু শর্ট-কাট করে লেখার কথা। বলুন তো, এটা কি সব ক্ষেত্রে সম্ভব?’ এবার গনি রুদ্র হেসে হেসে বলেন, ‘ দাদার দেখছি স্যারের ওই শর্ট আর কাট নিয়ে চিন্তা বেড়ে গেল তুষার ভাই। আর হবেই বা না কেন, শামদাদার তো আমাদের সেই বঙ্কিমি ভাষায় ইলাবোরেট লেখার অভ্যাস ’। -‘ হ্যাঁ ভাই, আর আপনি বুঝি টেডি টেডি ভাবে সব লেখেন?’ দুজনের কথায় ছেদ টানতে চোকদার রফিক, ‘আরে রাখুন তো আপনাদের শর্ট আর টেডির ভাবনা। এবার কাজের কথায় আসুন। তুষার ভাই, আমাদের ফ্লোরের ওয়াটার পিউরিফাইং মেশিনটা যে নষ্ট হয়ে গেল দীর্ঘ দিন ধরে, তার একটা ব্যবস্থা করার কথা বলুন না বড় স্যারের কাছে’। -‘হ্যাঁ, সেটা আমার মাথায় আছে। ভাবছি কালই কথাটা বলবো স্যারের কাছে’। -মিজির সহমত। সঙ্গে সঙ্গেই হঠাত্ যেন লাফিয়ে ওঠে আবার মিজি বলেন, ‘ইউরেকা, পেয়ে গেছি’। -‘কি পেলেন?’- সবার বিস্ময়াভিভূত প্রশ্ন। মিজি সবাইকে এবার অপেক্ষাকৃত নিচু গলায় বলেন, ‘শোন তোমরা, আমাদের নতুন পিউরিফাইং মেশিন কিনতে হলে তো আমাদের সকলে মিলে বড় স্যার বরাবর দরখাস্ত দিতে হবে?’ -‘হ্যাঁ, তাতে কী এমন পেলেন যে স্যারের খিটিমিটি মেজাজ থেকে রক্ষা পাবেন?’-শাম লাহার ঔত্সুক্য সম্বলিত প্রশ্ন। এবার গনি রুদ্র জানতে চান, ‘আমাদের চার জনেরই কি আলাদা করে অ্যাপ্লাই করতে হবে?’ - ‘না, তা নয়। চার জনের অ্যাপ্লিকেশন পড়ার ধৈর্য নেই বড় স্যারের। অ্যাপ্লিকেশন একটাই লেখবো, তোমরা শুধু নামসহ স্বাক্ষর দিয়ে দেবে’। - তুষার মিজি বললেন। -‘অ্যাপ্লিকেশন হয়তো একটাই দিলাম। কিন্তু, এর ভেতর কী এমন তেলেসমাতি ম্যাজিক আছে, সেটা আমাদের ক্লিয়ার হলো না তুষার ভাই’। - চোকদার রফিকের সন্দিগ্ধ প্রশ্ন। উত্তরে মিজি তাদেরকে বোঝালেন যে তিনি যা যা বললেন, সেভাবে যেন একটা সংক্ষিপ্ত দরখাস্তে সকলের সংক্ষিপ্ত স্বাক্ষর সহ বড় সাহেবের টেবিলে উপস্থাপন করতে হবে এবং তার জন্য তিনি যতটা শর্ট-কাট করা যায়, সেরকম একটা লেখা দিতে পারলেই স্যারকে কৌশলে একটা সমুচিত শিক্ষা দেয়ার মওকা লুক্কায়িত থাকবে। প্লাণের মাথা-মুণ্ডু কিছু না বুঝলেও অগত্যা সহকর্মীগণ নিশ্চিন্তে যে যার কাজে মন দিলেন। অতঃপর নির্দিষ্ট সময়ে অফিস ত্যাগ করে যার যার বাড়ি চলে গেলেন। মিজি গেলেন অফিস আওয়ার শেষ হওয়ারও প্রায় ঘণ্টা খানেক পর। একটু সকাল সকাল করেই পরদিন তুষার মিজি অফিসে রওনা হলেন। কথা অনুযায়ী তার অন্য তিন সহকর্মী অর্থাত্, শাম লাহা, গনি রুদ্র ও চোকদার রফিক সবে মিলে কয়েক মিনিট পর মিজি সাহেবের টেবিলে এসে ঘিরে বসেন। বড় সাহেব আসেন সকাল দশটা/সাড়ে দশটা নাগাদ। মিজি কর্তৃক শর্ট-কাটে লেখা দরখাস্তখানায় আবেদনকারীর স্থানে নিজের এবং অপর তিন জনের নামের আদ্যক্ষরগুলো (সংক্ষিপ্তাকারে) পরপর লিখে একটা অফিস ফাইলে করে ম্যাসেঞ্জারের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘যাও, এই ফাইলটা বড় স্যারের টেবিলে রেখে এসো’। ম্যাসেঞ্জার সেমতে ফাইল নিয়ে রেখে দিল সাহেবের টেবিলে। সহকর্মীগণ স্বাক্ষর দিলেন যদিও, দরখাস্ত বা নামের সংক্ষিপ্ত রূপের কথা শুধু মিজিরই জানা ছিল। এটা মিজির উপর তাদের অগাধ বিশ্বাস। সকাল সাড়ে ১০টা, গট গট করে ঢুকলেন বড় সাহেব। সবাই দাঁড়িয়ে সালাম জানালেন। অতঃপর সবাই দুরু দুরু বক্ষে পিন-পতন নিঃস্তব্ধতায় কাজে মনোনিবেশ করলেন। কিন্তু, আর সবাই যথারীতি কর্ম চালিয়ে গেলেও মিজির যেন কাজে মন বসছিল না; কখন উপর থেকে সাহেবের ডাক আসে, এই ভাবনায়। অবশেষে প্রহর গোনার পালাশেষ, ম্যাসেঞ্জার এসে বললো, ‘আপনাদের তিন স্যারকেই বড় স্যার সালাম জানিয়েছেন; এক্ষুণি যেতে বলেছেন’। মুখ চাওয়া-চাওয়ী করে তত্ক্ষণাত্ উপরে গেলেন চার সাব-অর্ডিনেট স্টাফ। সাহেব যেন অগ্নিশর্মা। তাদের প্রদত্ত ফাইলটা সজোরে টেবিলে নিক্ষেপ করে ব্যাঘ্রের ন্যায় হুঙ্কার দিয়ে বললেন, ‘আপনাদের এতবড় স্পর্ধা ! আজ এই মুহূর্তে আমি সব ক’টাকে সাসপেন্ড করার চিঠি লেখবো’। সবাই কিছু না বোঝে কম্পমান হলেও তোষার মিজি তার শান্ত গলায় বলেন, ‘আমরা কি কোথাও কোন ভুল বা অন্যায় করেছি স্যার?’ -ভুল মানে? বদমাইশি কাজকে শুধু ভুল বলে? আপনাদের এতবড় বুকের পাটা যে আমাকে গালি দিয়ে দরখাস্ত লেখেন? -‘কো-কোথায় স্যার? ভুল বা বদমায়েশির সাজা আমরা মাথা পেতে নেবো স্যার’- তোষার মিজির কথা। - ‘এটা কি লেখেছেন?’ - সাহেব আরো গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করেন। -এটা তো আমাদের শর্ট-কাট নেইম ; মানে, নামের প্রথম অক্ষরগুলো পাশাপাশি লেখলাম স্যার। - আপনি আমাকে কি বোঝাতে চাইছেন ; আমি গরু চোর? - তওবা তওবা স্যার। আপনাকে তা লেখতে যাবো কেন? আপনিই তো বললেন যে বেশি বড় করে লেখায় আপনার ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। তাই, দরখাস্ত যথা সম্ভব শর্ট-কাট করে আমাদের চার জনের নামের আদ্যক্ষর লেখলাম। - কিসের আদ্যক্ষর, কি আপনাদের নাম? আবার মুখের উপর কথা? - না স্যার, বেয়াদপি মাফ করবেন। আমাদের নামগুলো বলছি ; যেমন- আমি- তুষার মিজি, শর্ট-কাট করে হয়=তুমি ; তারপর- শাম লাহা, শর্ট-কাট করে হয়=শালা ; গনি রুদ্র, শর্ট-কাট করে হয়=গরু ; চোকদার রফিক, শর্ট-কাট করে হয়=চোর। চার জনের শর্ট-কাট করা নাম একত্রে পাশাপাশি লেখাতে হয়ে গেল- ‘ তুমি শালা গরু চোর ’। মিজির একদমে দরখাস্তে চার জনের নামের শর্ট-কাট বিবরণ শোনে সাহেব যেন ‘হু ’ ধ্বনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে প্রমাদ গুণেন। অতঃপর কণ্ঠস্বর নামিয়ে বললেন, ‘ সবক্ষেত্রে শর্ট-কাটের দরকার নেই, যান ’। অবশেষে উত্ফুল্ল চিত্তে চার জনই নিচে নেমে তিন সহকর্মীই বোলারের উইকেট পতনের আনন্দ প্রকাশের ভাষা হাতের থাবায় থাবায় মেলানোর মতো মিজির সাথে থাবায় থাবায় হাত মিলিয়ে সমস্বরে বললেন, ‘তুষার ভাই জিনিয়াস’। জবাবে তুষার মিজি বললেন, ‘বোঝে নাও এবার, এরই নাম- শর্ট-কাটের বিড়ম্বনা ’। |