শিরোনাম: |
টেকসই কৃষিবান্ধব উন্নয়নে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন জরুরি
|
মো. আলতাফ হোসেন : দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও স্থিতিশীলতা সংরক্ষণে কৃষির ভূমিকাই মুখ্য। কৃষি খাতে দৃশ্যমান সাফল্যের পেছনে কৃষিবিদরা নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। তারা গবেষণার মাধ্যমে পরিবেশ উপযোগী প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন। দেশে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নের বিকল্প নেই।
বিশ্বের কয়েকটি দেশ জৈব কৃষিতে অনেক দূর এগিয়েছে। বাকিরা এ পথ ধরে এগিয়ে এলেই আমরা সম্মিলিতভাবে একটি স্বাস্থ্যকর ও পরিবেশবান্ধব পৃথিবী গড়ে তুলতে পারবো। পৃথিবী এগিয়েছে অনেক দূর। নানান সাংস্কৃতিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে মানুষ সহস্রাধিক বছরের সভ্যতা টিকে থাকার বিষয়টিকে শুধু নিশ্চিত করিনি, নিশ্চিত করেছে এর বিকাশকেও। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে মানুষ বেড়েছে দ্বিগুণ কিন্তু খাদ্য উত্পাদন বেড়েছে সাড়ে তিনগুণ। নিত্য নতুন ব্যাধি এসেছে, তার ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে। মানুষ বেড়েছে, প্রয়োজন হয়েছে বাড়তি খাদ্যের। ফসল উত্পাদন ব্যবস্থায় ‘সবুজ বিপ্লব’ এর মাধ্যমে অনায়াসে তার সমাধানও হয়েছে। বর্তমানে কৃষিতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার, কীটনাশক, গ্রোথ হরমন ও জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারে মানব স্বাস্থ্যসহ পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের যে মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে মানুষের সফলতার ধারাবাহিতায় তারও সমাধান এসেছে কৃষিতে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি অনুশীলনের মাধ্যমে। একে আমরা সবুজ কৃষিও বলছি। প্রকৃতির সহজলব্ধ উপাদানগুলোর ব্যবহার বৃদ্ধি করার মাধ্যমে ফসল উত্পাদনে ক্ষতিকর রাসায়নিকের দ্রব্যদির ব্যবহার সীমিত করে এবং জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে নবায়নযোগ্য শক্তি বৃদ্ধি করে আমরা কৃষিকে অনায়াসে পরিবেশবান্ধব করতে পারি। আমরা বিশ্ববাসী এ পথে এগিয়ে চলেছি। প্রয়োজন এখন শুধু সচেতনতা। টেকসই কৃষি উন্নয়নে নতুন বিপ্লব নিশ্চিত করতে টেকসই পদ্ধতি ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে কৃষি খাতে দৃশ্যমান সাফল্য অর্জনের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পরিবেশবান্ধব টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। তাই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং ক্রমহ্রাসমান জমির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কীভাবে দেশকে এগিয়ে নেয়া যায় তা ভাবতে হবে। তাই আমাদের অর্জিত জ্ঞান, দক্ষতা এবং উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে কৃষি ক্ষেত্রে একটি নতুন বিপ্লব সাধনে সক্ষম হতে হবে এবং সেই সাথে নতুন নতুন উদ্ভাবন ও গবেষণার মাধ্যমে সময়ের দাবি মোকাবিলা করে এগিয়ে চলাই হবে আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সম্প্রতি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিসংস্থা এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ ব্যবস্থাপনায় গড়ে তোলা দেশের সর্ববৃহত্ এবং সর্বাধুনিক খাদ্য নিরাপত্তা গবেষণাগারের পরীক্ষায় দেশের ৪০% খাদ্যেই ভয়ঙ্কর সব ভেজাল ও বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য উপস্থিতির প্রমাণ মিলেছে। কৃষিতে বিভিন্ন রাসায়নিক প্রয়োগের ফলে খাদ্যে পুষ্টি উপাদানগুলোর পরিমাণ একদিকে যেমন কমতে থাকে, তেমনি মাটির উর্বর শক্তি হ্রাস পেতে থাকে। মাটিতে বসবাসকারী উপকারী অণুজীবগুলো মারা যায়। মাটি, পানি ও বায়ু দূষিত হয়। গ্রিন হাউস গ্যাসের উদগিরণ হয় এবং জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন হয়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিসংস্থা-এর মতে, প্রতি বছর অন্তত পৃথিবীতে ৪০০০০ হাজার মানুষ কীটনাশকের কারণে মৃত্যুবরণ করে। বাংলাদেশেও কৃষিতে রাসায়নিক প্রয়োগের কারণে খাদ্য বিষাক্ত হয়ে ওঠছে। পরিবেশবান্ধব কৃষির ওপর খড়ত্ফ ঘড়ত্ঃয-নড়ঁত্হব ১৯৪০ সালে খড়ড়শ ধঃ ঃযব ষধহফ গ্রন্থ লিখেন। রাসায়নিক কৃষির পরিবর্তে প্রাকৃতিক বা জৈব কৃষির ওপর গুরুত্বারোপ করাই ছিল গ্রন্থটির লক্ষ্য। ১৯৬২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানী জধপযবষ ঈধত্ংড়হ রে ঝরাবহঃ ংঢ়ত্রহম গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর পরিবেশবান্ধব কৃষির বিষয়টি বিশ্বব্যাপী একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়। সচেতনতা সৃষ্টি হয় এবং জৈব কৃষি ও খাদ্যের প্রতি মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি পেতে থাকে। কৃষিকে পরিবেশবান্ধব করার পেছনে অনেকের নিরলস পরিশ্রম রয়েছে। রাসায়নিক সারের ক্ষতিকর দিকগুলো জোরালোভাবে আমলে নেন অস্ট্রিয়ার বিজ্ঞানী জঁফড়ষভ ঝঃবরহবত্. তিনি ১৯২৮ সালে কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১১১ জনকে পরিবেশবান্ধব কৃষির ওপর প্রশিক্ষণ দেন। এরপর কৃষিতে কৃত্রিম সবের উপর প্রশিক্ষণ দেন। এরপর কৃষিতে কৃত্রিম সারের পরিবর্তে প্রাকৃতিক বা জৈব চাষাবাদ পদ্ধতির ওপর গুরুত্ব দেয়া হতে থাকে। টঘঊচ (টহরঃবফ ঘধঃরড়হ ঊহারত্ড়হসবহঃ চত্ড়মত্ধসসব) কর্তৃক প্রকাশিক ত্বেবহ ঊপড়হসু জবঢ়ড়ত্ঃ হতে দেখা যায় বিশ্বে উদিগরিত গ্রীণ হাউস ব্যাস নাইট্রাস অক্সাইডের ৫৮% এবং মিথেনের ৪৭% উদিগরণ হয়ে থাকে কৃষি থেকে। কৃষি হতে মোট প্রায় ৫ বিলিয়ন টন গ্রীন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হয়ে থাকে। বিগত ৫০ বছর রাসায়নিক সার ব্যবহারের কারণে পানিতে ফসফরাস মিশ্রণের হার ৭৫% বৃদ্ধি পেরেছে। জৈব ও সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার (ওচগ) মাধ্যমে কৃষিকে পরিবেশবান্ধব করার বিষয়টি আজকে বিশ্বে স্বীকৃত হয়েছে। জৈব বা স্থাপনার মাধ্যমে একদিকে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায় অপরদিকে পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্য রক্ষা পায়। সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উত্পাদিত খাদ্য থাকে বিষমুক্ত। ওহঃবত্হধঃরড়হধষ অমত্রপঁষঃঁত্ব জবংবধপয- ২০০০ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী জমিতে রাসায়নিক প্রয়োগ, মৃত্তিকা ক্ষয়সহ বিভিন্ন কারণে বিশ্বের ৪০% কৃষি জমির অবক্ষয় ঘটেছে। আবার খাদ্যের মধ্যে ক্ষতিকর উপাদানের উপস্থিতির কারণও প্রচলিত কৃষি ব্যবস্থা। এ সকল সমস্যা সমাধানে পরিবেশবান্ধব কৃষি সম্প্রসারণ আজ সময়ের চূড়ান্ত দাবিতে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের কয়েকটি দেশ জৈব কৃষিতে অনেক দূর এগিয়েছে। বাকিরা এ পথ ধরে এগিয়ে এলেই আমরা সম্মিলিতভাবে একটি স্বাস্থ্যকর ও পরিবেশবান্ধব পৃথিবী গড়ে তুলতে পারব এই হোক আমাদের প্রত্যাশা। কৃষিকে পরিবেশবান্ধব করতে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে কোঁচা কম্পোস্ট জৈব সার উত্পাদন ও জমিতে প্রয়োগ করে ফসল উত্পাদনের কাজ আরম্ভ হয়েছে। দেশে উত্পাদিত জীব কীটনাশক ও বালাইনাশক ফসল প্রয়োগ করে সীমিত আকারে বিষমুক্ত পুষ্টিকর খাদ্য উত্পাদন করা হচ্ছে। ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইঙচগঅ (ইধহমষধফবংয ঙত্মধহরপ চত্ড়ফঁপঃং গধত্ঁভধপঃঁত্বং অংংড়পরধঃরড়হ) বর্তমানে এ সংস্থায় সদস্য শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৪৯টির অধিক। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইঝঝচঅ (ইধহমষধফবংয ঝড়ুনবধহ ঝড়ুভড়ড়ফং চত্ড়ফঁপবত্ং অংংড়পরধঃরড়হ) উল্লেখ্য, ২০০৮ সালে কাজী এন্ড কাজী টি কো জৈব খাদ্য উত্পাদনে প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। তা সত্ত্বেও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনের তুলনায় বাংলাদেশে জৈব কৃষির বর্তমান অবস্থান সন্তোষজনক নয়। একদিকে জৈব সার ও কীটনাশকের অভাব অপরদিকে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের সহজ প্রাপ্তি মূলত এর কারণ। দেশে পরিবেশবান্ধব কৃষির ব্যাপক সম্প্রসারণের লক্ষ্যে আমাদের করণীয়। ১। পর্যায়ক্রমে সকল শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়া। ২। উন্নত জৈব প্রযুক্তি উদ্ভাবন কার্যক্রম আরও জোরদার করা। ৩। কৃষকের মাঝে জৈব সার ও কীটনাশক তৈরি পদ্ধতি জানিয়ে দেয়ার কাজটি জোরদার করা। ৪। জৈব কীটনাশক উত্পাদনের লক্ষ্যে নিম, বিষ কাটারি ধাতুরা, বনকলমি, নিশিন্দা প্রভৃতি উদ্ভিজ আরো বেশি করে রোপণ করা। ৫। পরিবেশবান্ধব কৃষির বিষয়ে মানুষকে ব্যাপকভাবে সচেতন করা। ৬। নতুন জ্ঞানের উদ্ভাবন এবং সুদক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা। ৭। টেকসই কৃষিবান্ধব উন্নয়নে উদ্ভাবন ও নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্বজুড়ে তথ্যপ্রযুক্তি সম্প্রসারণের বিষয়টি উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে আইসিটি সেক্টরে ব্যাপক অগ্রগতি ছাড়া জ্ঞানের বহুমুখী ব্যবহার ও উন্নয়ন সম্ভব নয়। |