শিরোনাম: |
সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ প্রয়োজন
|
ড. মো. হুমায়ুন কবীর : সড়ক দুর্ঘটনা দেশের জন্য একটি অপ্রত্যাশিত মরণফাঁদ। একে প্রতিরোধ করতে হলে জনসচেতনতার বিকল্প নেই। তাই গত ২৮ জানুয়ারি ২০১৭ তারিখে ‘নিরাপদ সড়ক চাই-নিসচা’ এর উদ্যোগে জনসচেতনতার উদ্দেশ্যে একটি মহাসম্মেলন করা হয়। রাজধানী ঢাকার মহানগর নাট্যমঞ্চে ‘পথ যেন হয় শান্তির, মৃত্যুর নয়’ স্লোগানে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের সভাপতিত্বে ৭ম সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। সেখানে সারাদেশ থেকে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার অনেক মানুষ উপস্থিত ছিলেন। সেখানে উপস্থিত প্রধান অতিথিসহ বক্তাগণ সড়ক দুর্ঘটনা রোধে একটি পূর্ণাঙ্গ ও কার্যকরী আইন প্রণয়নের ওপর তাগিদ দিয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৫ সালের পরিসংখ্যানমতে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ক্ষেত্রে এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম এবং সারা বিশ্বের হিসাবে বাংলাদেশের এ অবস্থান ১৩তম যা নিঃসন্দেহে খুবই উদ্বেগজনক। ‘নিসচা’ একটি বেসরকারি অরাজনৈতিক অলাভজনক জনসচেতনতামূলক সংগঠন যেটি ১৯৯৮ সাল থেকে জাতীয়ভাবে সড়ক দুর্ঘটনা বিষয়ে দেশের জনগণকে সচেতন করার জন্য প্রতি বছরের ২২ অক্টোবরকে ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। দিবসটি উপলক্ষে সংগঠনটির পক্ষ থেকে প্রতি বছরই ব্যানার, ফেস্টুন, প্রচারপত্র, র্যালি, বিভিন্ন দাবি ও পরামর্শমূলক স্মারকলিপি দাখিল ও মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়ে থাকে। এ বছরও (২০১৬) ‘দোষারোপ নয়, দুর্ঘটনার কারণ জানতে হবে, সবাইকে নিয়ম মানতে হবে’ শীর্ষক প্রতিপাদ্যকে সামনে নিয়ে অনুরূপ কর্মসূচিই যথাসময়ে পালন করা হয়েছে। বিশ্বের সড়ক দুর্ঘটনা সম্পর্কিত এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, সারা বিশ্বে বছরে প্রায় এক কোটি চল্লিশ লাখ লোক বিভিন্নভাবে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়। সেখান থেকে প্রায় এগারো লাখ লোকের মৃত্যু হয়, আর আহত হয়ে মারাত্মক পঙ্গুত্ববরণ করে থাকে আরও অনেকে। বাংলাদেশের দুর্ঘটনা বিষয়ে পুলিশের হিসাব থেকে জানা যায়, বছরে ৫ থেকে ৭ হাজার লোকের মৃত্যু হয় সড়ক দুর্ঘটনার মাধ্যমে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে এ মৃত্যুর সংখ্যা বছরে একুশ হাজারের বেশি। কিন্তু বুয়েটের ‘দুর্ঘটনা গবেষণা সেন্টারের’ তথ্যমতে দেশে বছরে ১১ হাজারের মতো লোক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করে থাকে, সেখানে আরও প্রায় ৪০ হাজার লোক বিভিন্নভাবে দুর্ঘটনাজনিত অসুস্থতায় পতিত হয় এবং তারমধ্যে একটি বিরাট অংশ সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করে কর্মক্ষমতা হারিয়ে নিজের কাছে, পরিবারে, সমাজে এবং সর্বোপরি দেশের বোঝায় পরিণত হয়। ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালের এক সমীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্যমতে, সেখানে চিকিত্সায় আসা ৫৬% ভাগ রোগীই হলো দুর্ঘটনার শিকার হয়ে আসে। এসব দুর্ঘটনায় সরকারের মোট স্বাস্থ্য বাজেটের ৩০% এবং মোট জিডিপির ২% খরচ করতে হয়। আর্থিক হিসাবে দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতির পরিমাণ ৫ হাজার থেকে ৭ হাজার কোটি টাকা। আর পতিত এসব দুর্ঘটনার শিকারে পরিণত হতে দেখা যায় নারী ও শিশুদের একটি বিরাট অংশ। এই তো সেদিনও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অসচেতনভাবে সেলফি তুলতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে তিন কিশোরের করুণ মৃত্যু হলো। কথায় আছে, দুর্ঘটনা তো দুর্ঘটনাই, সেটি তো কেউ আর ইচ্ছে করে তৈরি করে না। এ কথা ঠিক যে বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশেও সংখ্যায় কম হলেও একেবারে দুর্ঘটনা মুক্ত নয় তারা। তবে আবার এ কথাও ঠিক যে, দুর্ঘটনার জন্য বিশেষ কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ দায়ী। সে কারণগুলো চিহ্নিত করে তদানুযায়ী প্রয়োজনীয় সতর্কতা ও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে দুর্ঘটনা অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব। এ বিষয়টি স্বীকার করেন খোদ সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা অত্যন্ত সুপরিচিত একটি স্বেচ্ছাসেবী ও সচেতনমূলক সংস্থা ‘নিরাপদ সড়ক চাই-নিসচা’ আন্দোলনের চেয়ারম্যান বিশিষ্ট অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন। তিনি সম্প্রতি গত ১ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে রাজধানী ঢাকায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সামনে বিশিষ্টজনদের নিয়ে আয়োজিত নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের সপক্ষে একটি মানববন্ধনে বলেন, ‘যদিও আগের তুলনায় সড়ক দুর্ঘটনা এখন অনেকটাই কমে এসেছে, তারপরও উদ্বেগজনকভাবে তা বেড়ে চলেছে ঈদের ছুটিতে। আর সাম্প্রতিক সময়ে রমজান এবং কোরবানি ঈদে প্রচুর সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং কোরবানি ঈদে তা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে এতে প্রায় মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে দুই শতাধিক লোকের প্রাণ গেছে। বাংলাদশে সড়ক দুর্ঘটনা বিষয়ে অনেকে অনেক সময় কথা বলে আসলেও এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছেন পুরোধা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ইলিয়াস কাঞ্চন। ১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর তারিখে ইলিয়াস কাঞ্চন সপরিবারে পার্বত্য এলাকায় বেড়াতে গেলে সেখানে মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন তার স্ত্রী বেগম জাহানারা কাঞ্চন। সেই বিষয়টি তিনি স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেননি। তিনি তখন থেকেই সোচ্চার হন সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ক্যাম্পেইনে। তারই অংশ হিসেবে তিনি সে বছরই ডিসেম্বরে গঠন করেন তার নেতৃত্বে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ সংগঠনটি। ১৯৯৮ সাল থেকে এর সপক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে তার স্ত্রীর মৃত্যুর দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। ইতোমধ্যে দিনটিকে জাতীয়ভাবে পালনের জন্য সরকারের কাছে আবেদনও করা হয়েছে। এবারও ২৩তম এ দিবসটি পালনের জন্য সংগঠনটির চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন ২০ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে এক সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করে সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর জন্য সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়ার অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি দুর্ঘটনা প্রতিরোধ সেল গঠনের অনুরোধ জানান। সেখানে এলজিইডি, যোগাযোগ, সড়ক ও সেতু, স্বরাষ্ট্র, কৃষি, স্বাস্থ্য, আইন প্রভৃতি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে একটি সমন্বিত সেল খোলার পরামর্শ দিয়েছেন নিসচা-এর পক্ষ থেকে। তাদের ধারণামতে এটি হলে সুষ্ঠু তদারকির মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা অনেক কমে আসবে। একটি দুর্ঘটনা শুধু একজন মানুষ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে না। দুর্ঘটনায় কবলিত ব্যক্তির সঙ্গে সঙ্গে তার পরিবারের বিরাট ক্ষতি হয়ে যায়। একটি দুর্ঘটনা যে সারা জীবনের কান্না- একথা বলা যায়। এসব দুর্ঘটনা শুধু যে সড়কেই সীমাবদ্ধ থাকছে তা নয়। রেল দুর্ঘটনা, নৌ-দুর্ঘটনা এমনকি বিমান দুর্ঘটনাও এর সঙ্গে যুক্ত। তবে এদের মধ্যে কোনোটিতে কম আবার কোনোটিতে একটু বেশি এই আর কি। এসব দুর্ঘটনা কোনো এক পক্ষের দ্বারা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব এমনটি নয়। এরজন্য প্রয়োজন সমস্যার মূলে সবাইকেই সচেতনভাবে কাজ করতে হবে। তার মধ্যে দুর্ঘটনায় দায়ী ড্রাইভাররা যেন সহজেই ছাড়া পেয়ে যেতে না পারে, তাদের জন্য যাতে আইনানুযায়ী কমপক্ষে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান কার্যকর করা যায় সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। সেইসঙ্গে বর্তমানে প্রচলিত আইনটিকে আরও কঠোর ও প্রায়োগিক হিসেবে হালনাগাদ করতে হবে। রাস্তার ত্রুটি দূর করে ট্রাফিক আইন মেনে রাস্তায় পথচারী চলাচল, রাস্তায় সঠিকভাবে গাড়ি চালানো, সেইসঙ্গে চলাচলকারী যাত্রীদেরও সচেতনভাবে ট্রাফিক আইন মেনে চলতে হবে। ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল বন্ধ করতে হবে, ড্রাইভারদের সঠিকভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলেই সারাদেশের সর্বক্ষেত্রে সড়ক দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব হবে। সরকার এ বিষয়ে খুবই আন্তরিকভাবে কাজ করছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি সড়ক চারলেনে উন্নীত করায় এবং সেসব সড়কে কমগতির গাড়ি নিষিদ্ধ করায় সেখানে পূর্বের তুলনায় দুর্ঘটনা অনেক কমে গেছে। কাজেই এগুলোই হলো সচেতনতা বৃদ্ধির উপায়। নিরাপদ সড়ক দিবসের বিভিন্ন কর্মসূচিতে এটাই সবার প্রত্যাশা থাকে। আগামী দিনেও এ বিষয়ে গৃহীত যে কোনো উদ্যোগের সঙ্গে সবাইকে থাকার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ কেউই দুর্ঘটনায় অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু কিংবা পঙ্গুত্ব কোনোটাই চায় না। লেখক: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় |