শিরোনাম: |
ইন্টারনেট ব্যবহার-অপব্যবহার
|
ফারিহা হোসেন প্রভা : ইন্টারনেটের ব্যাপক জনপ্রিয়তায় শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ কম্পিউটার নিয়ে বেশির ভাগ সময় কাটায়। কম্পিউটার ও ইন্টারনেট এখন মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইন্টারনেটে কী আছে- সে প্রশ্নের উত্তরের চেয়ে কী নেই- তার উত্তর দেয়া সহজ। ইন্টারনেটকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা এখন প্রায় অসম্ভব। সংবাদ, তথ্য, যোগাযোগ, কেনাকাটা, ব্যবসা-বাণিজ্য, সোস্যাল নেটওয়ার্ক, বিনোদন প্রভৃতির জন্য মানুষ এখন ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু কেউ যদি ইন্টারনেটের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, এ কারণে যদি কারো স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিঘ্নিত হয় এবং সিগারেট, মদ ও ড্রাগের মতো ইন্টারনেটের প্রতি যদি কেউ আসক্ত হয়ে পড়ে তখনই সমস্যা। আর তখনই সমস্যায় পড়তে হয় ব্যবহারকারীর বন্ধু, স্বজন, পরিবার ও সমাজকে।
এ কারণে ইন্টারনেট আসক্তির ব্যাপারটি গুরুত্ব দিয়ে দেখা প্রয়োজন। ইন্টারনেটে আসক্তির বিষয়টি প্রথমে মনোবিজ্ঞানীদের নজরে আসে ১৯৯৭ সালে। ঈরহপরহহধঃর ঈধংব এর মাধ্যমে। স্যানড্রা হ্যাকারব নামে একজন মহিলা তার তিনটি শিশু সন্তানকে অবহেলা করে ও নির্জন কামরায় আবদ্ধ রেখে দৈনিক ১২ ঘণ্টারও বেশি সময় ইন্টারনেটে অতিবাহিত করতেন। এই মহিলাকে পর্যবেক্ষণ করে মনোবিজ্ঞানীদের অনেকেই সম্মত হলেন যে সিগারেট, মদ ও ড্রাগের মতো ইন্টারনেটেরও পড়সঢ়ঁষংরড়হ করার ক্ষমতা আছে। অর্থাত্ যা একটি পর্যায়ে এসে মানুষ ইচ্ছার বিরুদ্ধেও ইন্টারনেট ব্যবহার করতে বাধ্য হয়। সেই ধারণা থেকেই ‘ওহঃবত্হবঃ অফফরপঃরড়হ’ কথাটির সৃষ্টি। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইন্টারনেটেরও পরিবর্তন হচ্ছে। আসছে নতুন নতুন ফিচার, ফাংশন, কনসেপ্ট। একই সঙ্গে বাড়ছে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। জরিপে দেখা গেছে যে ৫-১০ শতাংশ ব্যবহাকারী ইন্টারনেট আসক্ত। এর সংখ্যা যে দিন দিন বাড়ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ইন্টারনেটকে কেন্দ্র করে মানুষের যে ব্যাপক কৌতূহল, সার্বক্ষণিক চিন্তা, অদমনীয় ইচ্ছা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এবং অসংযত আচরণবোধ এসব কিছুকেই ইন্টারনেট আসক্তি বলা যায়। ১৯৬৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগ প্রতিরক্ষার জন্য নিজস্ব নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা গড়ে তোলেন, যার উদ্দেশ্য ছিল পারমাণবিক আক্রমণ ঠেকানোর জন্য বৈজ্ঞানিক তথ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য আদান প্রদান ও সংরক্ষণ করা। এর নাম দেয়া হয় ‘আরপানেট’। সত্তরের দশকের শেষ দিকে শুধু যুক্তরাষ্ট্রে সামরিক গণ্ডির মধ্যে হাঁটি হাঁটি পা পা করে যাত্রা শুরু করে এই আরপানেট। পরে ধীরে ধীরে এটি মহীরুয়ে পরিণত হয়। এখন আরপানেট নাম পরিবর্তিত হয়ে ইন্টারনেট নাম ধারণ করে। এই ইন্টারনেট স্বল্প সময়ের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তরে পৌঁছে গেছে। বিশ বছরের কম সময়েই সারাবিশ্বে এই ইন্টারনেট একটি ডিজিটাল বিপ্লবের সূচনা করেছে। বিশ্বে ধনী, দরিদ্র, ছোট বড় সবাইকে যেন একীভূত করে একটি গ্লোবাল ভিলেজে জড়ো করেছে। বর্তমানে ইন্টারনেটকে বলা হয় তথ্যপ্রযুক্তির সূতিকাগার। এটি জ্ঞানের অবারিত হাজার দরজা খুলে দিচ্ছে আমাদের সামনে। এর মাধ্যমে মানব সভ্যতা যেমন উপকৃত হচ্ছে, তেমনি এর অপকারিতাও রয়েছে। যা মানব সভ্যতাকে অবক্ষয়ের অন্ধকূপে নিক্ষেপ করছে। ইন্টারনেট বর্তমানে সন্ত্রাসীদের ভয়ঙ্কর হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। কারণ ইন্টারনেটের জন্মই হয়েছে সন্ত্রাসবাদী চিন্তা ধারা থেকে। তাই ইন্টারনেট এখন সন্ত্রাসের নিরাপদ অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। বর্তমান যুগে সাইবার সন্ত্রাসেরও যুগ। এই প্রযুক্তি সাম্রাজ্যবাদীদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। ২০০৭ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়- শুধু সাইবার অপরাধের কারণে ২০০৭ সালে পৃথিবীতে ১০ হাজার কোটি ডলারের ক্ষতি হয়েছে। এন্তেজানিয়ার দেশে সাইবার ক্রাইম পুরো সরকার ব্যবস্থার ওপর আঘাত হেনেছে। সেখানে দুটি বড় ব্যাংক, ছয়টি সংবাদপত্রসহ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ওপর আঘাত হানা হয়েছে। সেখানে হ্যাকাররা এসব সংস্থার সব তথ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছে। শুধু এন্তেজানিয়া নয় সাম্রাজ্যবাদীদের ইন্ধনে পৃথিবীর সব দেশ সাইবার সন্ত্রাসে আক্রান্ত। বছরখানেক আগে বাংলাদেশ ব্যাংক রির্জাভ হ্যাক করে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয় হ্যাকার চক্র। একইভাবে অনেক দেশ বিপন্ন হওয়ার পথে। কিন্তু যে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো সাইবার সন্ত্রাসের মাধ্যমে পৃথিবীর একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তারাও সাইবার সন্ত্রাস থেকে মুক্ত নয়। বরং উন্নত বিশ্বে সাইবার ক্রাইমের ঘটনাগুলোই বেশি ঘটছে। উন্নত বিশ্বে সাইবার অপরাধকে অপরাধের তালিকায় শীর্ষে স্থান দেয়া হয়েছে। এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বর্তমান ইন্টারনেটের তথ্য ভাণ্ডারের প্রায় ২৫ ভাগই পর্নোগ্রাফি। বর্তমানে ইন্টারনেটে মোট ২০ কোটির অধিক ওয়েবসাইটের মধ্যে ৫ কোটি পর্নোগ্রাফি ওয়েবসাইট রয়েছে। শিশুদের নিয়ে তৈরি অশ্লীল ছবির ওয়েবসাইট রয়েছে ১ কোটি ৫০ লাখের বেশি। ১০ লাখের বেশি শিশুর ছবি রয়েছে এসব সাইটে। ১০ লাখের মতো অপরাধী এসব অবৈধ ব্যবসায় যুক্ত। এই ভয়ঙ্কর থাবার বিস্তার থেকে আমাদের তরুণ সমাজের মুক্তি এখন রীতিমতো চ্যালেঞ্জ। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে খ্যাত ওয়েবসাইটগুলো দেশের তরুণ সমাজকে অন্ধকারের দিকেই ধাবিত করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এক গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগ ওয়েবসাইট মাইস্পেস তরুণ সদস্যদের নিয়ে বিপাকে পড়েছে। এসব তরুণ মাইস্পেস ব্যবহারকারীর বেশিই ভাগই অনিরাপদ যৌন কিংবা মাদকাসক্তের মতো ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ প্রকাশ করছে। ইউনিভার্সিটি অব উইসকন মিনের গবেষক মিগ্যান মরিনো ২০০৭ সালের ১৮ বছরের ৫০০ তরুণ তরুণীর মাইস্পেস অ্যাকাউন্টের প্রোফাইল বিশ্লেষণ করেছেন। এতে দেখা যায়, ৫৪ শতাংশ অ্যাকাউন্টধারীর প্রোফাইলে ঝুঁকিপূর্ণ আচরণের ইঙ্গিত রয়েছে। ৪১ শতাংশের প্রোফাইলে পাওয়া গেছে মাদক ও বিভিন্ন মাদক দ্রব্যের অপব্যবহার সংক্রান্ত তথ্য। ২৪ শতাংশের অ্যাকাউন্টে আছে যৌন আচরণের নজির এবং ১৪ শতাংশের প্রোফাইলে সহিংস ঘটনায় জড়ানোর মতো তথ্য পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে শিশু ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো। গবেষক ড. দিমিত্রির মতে, যেসব তরুণ তরুণীর মাইস্পেস অ্যাকাউন্ট আছে তাদের অধিকাংশই এমন ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ করে যা সহজেই চোখে পড়ে। আপত্তিকর আচরণ প্রমাণিত হওয়ায় মাইস্পেস এ পর্যন্ত প্রায় ৯০ হাজার সদস্য অপসারণ করেছে। এবার আসি হ্যাকার প্রসঙ্গে। হ্যকার একজন বড় অপরাধী। তবে এই অপরাধীর মধ্যে একজন দক্ষ ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া যায়। একজন হ্যাকার তথ্য প্রযুক্তিতে অনেকের চেয়ে দক্ষ এবং যোগ্য। কম্পিউটার ভাইরাস কোনো ক্ষতিকর রোগ জীবাণু নয়। এটি একটি ক্ষতিকারক প্রোগ্রাম। এই প্রোগ্রামগুলো একজন বা একাধিক প্রোগ্রামার লিখে থাকে। একজন প্রোগ্রামারের লেখা কোনো ক্ষতিকর প্রোগ্রাম যখন কম্পিউটারে প্রবেশ করে তখন ওই কম্পিউটার নষ্ট হয়ে যায়। প্রোগ্রামাররা ওই প্রোগ্রামগুলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছড়ায়। এই ভাইরাসকে ওয়ার্মও বলা হয়ে থাকে। অনেক ভাইরাস আছে যেগুলো কম্পিউটারকে সরাসরি অচল করে দেয় না। কম্পিউটারে গতি, বিভিন্ন ফাইল ও ফোল্ডার ওলট-পালট করে ফেলে। কখনো কখনো কম্পিউটারে ঘাপটি মেরে থেকে কম্পিউটরের গতিকে শ্লথ করে দেয়। অনেক সময় দেখা যায়, প্রোগ্রামাররা অনেক ওয়েবসাইটে অনুপ্রবেশ করে ওয়েবসাইট নষ্ট করে। এমনকি আস্ত ওয়েবসাইটটিকে গায়েব করে ফেলে। যারা এ কাজ করে তারাই হ্যাকার। আর তাদের কাব্যগুলোকে বলা হয় হ্যাকিং। তারা ওইসব ওয়েবসাইটের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে সাইটে প্রবেশ করে যা কি-না নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। হ্যাকিং ঠেকাতে কম্পিউটার জায়ান্টরা নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করলেও আশঙ্কাজনক হারে রাড়ছে হ্যকারদের দৌরাত্ম্য। অনলাইন বিশ্ব এখন আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, হ্যাকররা প্রতি ৩৯ সেকেন্ডে একবার কম্পিউটারকে আক্রমন করছে। আর এর অধিকাংশই ঘটছে ব্যবহারকারীর পাসওয়ার্ড ভাঙার মাধ্যমে। অ্যান্টিভাইরাস নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো হ্যাকারদের প্রধান পৃষ্টপোষক। তারা হ্যাকারদের মোটা অঙ্কের বেতনে চাকরি দেয়। হ্যাকারদের কাজই হলো মাঝে মাঝে ক্ষতিকর প্রোগ্রাম লিখে অর্থাত্ ভাইরাস তৈরি করে ব্যাপক আকারে কম্পিউটার অচল করে দেয়া। ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার এক বা দু’দিন পর ওই ভাইরাসের অ্যান্টিভাইরাস বাজারে ছাড়ে হ্যকারদের পৃষ্ঠপোষক কোম্পানিগুলো। ওই অ্যান্টিভাইরাস আগেই তৈরি করা থাকে। ২০০৭ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সাইবার অপরাধের কারণে পৃথিবীর ১০ হাজার কোটি ডলার ক্ষতি হয়। শুধু কম্পিউটার সংক্রান্ত তথ্যের ক্ষতি হয় ৪ হাজার কোটি ডলার। ২০০৮ সালে কম্পিউটার হ্যাকাররা কমপক্ষে সাড়ে ২৮ কোটি রেকর্ড চুরি করেছে। এর আগের চার বছরে হ্যাকাররা যত রেকর্ড চুরি করেছে, ২০০৯ সালে তারা তার সমপরিমাণ রেকর্ড চুরি করেছে। শুধু তাই নয়, তারা কম্পিউটারগুলোকে অরক্ষিত করে রাখে। নতুন এক গবেষণায় এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভেরিজন কমিউনিকেশনস ইনকরপোরেটেড এই গবেষণা চালায়। ভেরিজন জানায়, চুরি করা রেকর্ডগুলোর ৯৩ শতাংশই অর্থ সংক্রান্ত। তারা সব সময় চেষ্টা করেছে ক্রেডিট কার্ডের নম্বর, ব্যাংকের স্পর্শকাতর সব তথ্য চুরি করতে। এছাড়া হ্যাকাররা কম্পিউটারে অনুপ্রবেশ করতে অত্যাধুনিক সব প্রোগ্রাম ব্যবহার করে। সাইবার অপরাধীরা এখন আর আগের মতো শুধু কম্পিউটারের ভাইরাস আক্রান্ত করে। পরে আক্রান্ত কম্পিউটারের থেকে তথ্য চুরি করে তা অনলাইনে নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করছে। ২০০৯ সালে ইউরোপে অনুষ্ঠিত তথ্য নিরাপত্তাবিষয়ক সম্মেলনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। ইতোমধ্যে এ রকম স্পর্শকাতর চোরাই তথ্য বিক্রির জন্য হাজারো ওয়েবসাইট গড়ে উঠেছে ইন্টারনেটে। এছাড়া ক্রেডিট কার্ডের তথ্য বিক্রি হচ্ছে অনেক কম দামে। মাত্র কয়েক ডলারে এসব কার্ডের গোপন তথ্য বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। ২০০৯ সালের যুক্তরাজ্যের ব্যাংকের এক তথ্য বিবরণীতে দেখা যায়- টেলিফোন, ই-মেইল, ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যে ক্ষতি হয় তার মোট পরিমাণ দাঁড়ায় ২৯০ কোটি ৫ লাখ পাউন্ডের সমান। এমনি অবস্থায় সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে গবেষণার মাধ্যমে ইন্টারনেটে প্রতারণা, সাইবার অপরাধ থেকে পরিত্রাণে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি এ নিয়ে ব্যপক জনসচেতনতা গড়ে তোলা অপরিহার্য। নতুবা সর্বনাশা এ খেলায় পুরো জাতিকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেবে। লেখক: কলাম লেখক |