শিরোনাম: |
অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীক ২১ ফেব্রুয়ারি
|
স্বপন কুমার সাহা : ভাষা আন্দোলন বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। এর মাধ্যমে বাঙালি জাতি ও বিশ্ববাসীকে ধর্মান্ধতার অন্ধকার থেকে অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল আলোর জগতে মানবজাতিকে মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত করে। ভাষা আন্দোলনের চেতনা কেবল বাঙালি ও বাংলাদেশের একক সম্পদ নয়, এ এখন বিশ্ববাসীর মুক্তির বীজমন্ত্র হিসেবে স্বীকৃত। অতন্ত এ বিষয়ষে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা বাঙালি জাতি এ অর্জনে বুকভরে গর্ববোধ করি। আজ ২১ ফেব্রুয়ারি। আমরা সেই চেতনার মন্ত্রে- আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো..... গাইতে গাইতে শহীদ মিনারে পাদমূলে শহীদদের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের মাধ্যমে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ’৫২-র এই দিনটিকে স্মরণ করি।
পাকিস্তানের তত্কালীন শাসকগোষ্ঠী তাদের হীনস্বার্থ বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে বাদ দিয়ে সংখ্যালঘু জনগণের ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দিল। এর মধ্য দিয়ে সেই শাসকগোষ্ঠীর গভীর ষড়যন্ত্রের নীল নকশা ফুটে উঠল। যখনই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর এই নীল নকশার ষড়যন্ত্রের কথা তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল তখন পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ বুঝতে পারল পাকিস্তান নামক দেশটির সঙ্গে একই রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আর থাকা যায় না। শাসকগোষ্ঠী পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণের ভাষা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টির ওপরই শুধু নয়, বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করেছিল অর্থনৈতিকভাবেও। তত্কালীন পূর্ব-পাকিস্তানের ছাত্র-জনতার কাছে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গেলে পাকিস্তানের সঙ্গে আর তত্কালীন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতীক জাতীয় পতাকা ও সঙ্গীতকে শ্রদ্ধাভরে গ্রহণ করতে পারল না। শুরু হয় মায়ের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার আন্দোলন ও সংগ্রাম। পূর্ব-পাাকিস্তানের জনগণের স্বার্থে বিভিন্ন দাবি দাওয়ার মাধ্যমে ধাপে ধাপে বেগবান হতে থাকে জনগণের আন্দোলনের গতি। এই আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রথম বীজবপন হলো। ১৯৫২’র ২১ ফেব্রুয়ারি। মায়ের ভাষা বাংলাভাষা প্রতিষ্ঠা করার জন্য বাংলার ছাত্র-জনতা-কৃষক-মজুর বুকের তাজা রক্ত দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে উদ্দীপ্ত হয়। এ জন্য শহীদ, বরকত, সালাম ও জব্বারসহ মহান ভাষা আন্দোলনের সূর্যসৈনিকরা বাংলাদেশের ইতিহাসে বীরের মর্যাদা নিয়ে চিরঞ্জীব হয়ে থাকবে। মায়ের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেয়ার ইতিহাস বিশ্বে আর কোনো দেশে পাওয়া যায় না। সেই চেতনার পথ ধরে পরবর্তীতে একটি স্বাধীন দেশের অভ্যুদয় ঘটে। বিশ্বের মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশ’। উড়ছে লাল-সবুজের পতাকা। ’৫২-র ভাষা আন্দোলন শহীদদের স্মরণে গড়ে ওঠে তত্কালীন পূর্ব-পাকিস্তানে জাতীয় শহীদ মিনার। এই শহীদ মিনার বা ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিসৌধকে ঘিরেই শুরু হয় বাঙালি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে আন্দোলন। একইসঙ্গে জনগণকেও অধিকার আদায়ের চেতনাকে আরো শাণিত করে। তাই আজকের এই শহীদ মিনার হলো বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এক উজ্জ্বল প্রতীক। শহীদ মিনার হলো বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের গৌরব। শহীদ মিনার হলো গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, শহীদ মিনার হলো বাঙালি জাতির সংস্কৃতি ও কৃষ্টির ধারা। তাই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বাঙালির ঘরে ঘরে সুপরিচিত। শুধু বাংলাদেশেই নয়, এই শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা এবং ২১ ফেব্রুয়ারিতে শহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর ভূমিকা আন্তর্জাতিক পরিসরে বিদেশের বুকেও স্বীকৃতি লাভ করেছে। কেননা শহীদ মিনার হলো একটি চেতনার প্রতীক। এই চেতানকে নস্যাত করতে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে শহীদ মিনারের ওপর আক্রমন চালায় এবং শহীদ মিনারটিই ছিল পাকি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু। ১৯৭১ সালে বাঙালিরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীনতা অর্জনে পাক-হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের জন্য চূড়ান্তভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তখন ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার ও বাঙালির জাতির ওপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করার সঙ্গে হানাদার বাহিনী শহীদ মিনারটিকেই গুঁড়িয়ে দেয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির পরদিনই ঢাকা মেডেকেল কলেজের ছাত্রদের উদ্যোগে গড়ে তোলা হয় প্রথম শহীদ মিনার। আন্দোলনের প্রতীকী মর্যাদা পাওয়ায় সেদিন বিকেলেই ঢাকা মেডিকেল হোস্টেল ঘেরাও করে মিনারটি গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। এরপর ১৯৫৭ সালে একটি নকশা তৈরি করেন শিল্পী হামিদুর রহমান। সে অনুযায়ী কাজ শেষ হলে মূল অংশের মঞ্চে দাঁড়ানো মা ও শহীদদের প্রতীক হিসেবে থাকত অর্ধবৃত্তকার স্তম্ভ। গায়ে হলুদ ও গাঢ় নীল কাচের গড়া কিছু চোখের প্রতীক, মিনারের সামনে থাকার কথা ছিল বাংলা বর্ণমালা খচিত একটি রেলিং। মিনারের পাশে জাদুঘর, পাঠাগার, দীর্ঘ দেয়ালচিত্র ছাড়াও নকশায় ছিল আরও বেশ কিছু পরিকল্পনা। কিন্তু সেসব কাজ বন্ধ হয়ে যায় ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারির পর। ’৬২ সালে পূর্ব-পাকিস্তানের তত্কালীন গভর্নর আযম খানের নির্দেশে বদলে যায় মূল নকশা। পরিকল্পিত স্থাপত্যের বিস্তর অঙ্গহানির অভিযোগ ওঠে। পরে ’৬৩ সালে সে কাজ শেষ করা হয়। এরপর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে সংক্ষিপ্ত নকশায় আবারও গড়া হয় শহীদ মিনার। গবেষকদের মতে, ’৫২-র ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সংরক্ষণ অনীহার কারণে স্থাপত্যটি মূল নকশা অনুয়ায়ী বাস্তবায়ন হয়নি। তবে ২০১৮ সালের মধ্যে শহীদ মিনারের পরিসর বাড়ানো হচ্ছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানা গেছে। এসব কারণেই ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মত্যাগের ফলশ্রুতিতেই আজকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে সুপরিচিত ও বাঙালি জাতির গৌরব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের গৌরবময় আত্মত্যাগের মহীমা ধাপে ধাপে উজ্জীবিত হয়েছিল ১৯৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬-র আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর আইয়ুববিরোধী গণআন্দোলন। তারপর শুরু হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সর্বোপরি বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম। ৯ মাস পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ ও ২ লাখ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত ১৯৭১’র ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমে আজকের লাল-সবুজের পতাকার দেশ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। একটি দেশের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদশ তাই বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস অন্যান্য দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস থেকে ভিন্নতর। তাই আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশকে নিয়ে আমরা গর্বিত। বাংলাদেশের মাতৃভাষাকে নিয়ে আজ বিশ্ববাসীও গর্বিত ও উজ্জীবিত। বাংলাভাষা আজ জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতি লাভ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে পালন করা হচ্ছে। এটিই হলো বাংলাদেশের জনগণের গর্ব ও ঐতিহ্য। এই গর্ব ও ঐতিহ্য বাংলাদেশি জনগণের চলার পথকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলছে। ইউনেস্কো এবারের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্লোগান নির্ধারণ করেছে- ‘বহুভাষার শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে টেকসই ভবিষ্যতের পানে’ (ঞড়ড়িত্ফং ংঁংঃধরহধনষব ভঁঃঁত্বং ঃযত্ড়ঁময সঁষঃরষরহমঁধষ বফঁপধঃরড়হ) আর এই স্লোগানই নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দফতরে ২১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় এই প্রথমবারের মতো ‘মাতৃভাষা দিবস’ পালন করা হচ্ছে। সম্মিলিতভাবে এ কর্মসূচি ঘোষণা করে জাতিসংঘ সচিবালয়, ইউনেস্কোর নিউইয়র্ক অফিস, নিউইয়র্ক সিটি মেয়রের অফিস, জাতিসংঘে বাংলাদেশ, হাঙ্গেরি, মরিশাস, পেরু ও ভ্যানয়াটো মিশন। এছাড়াও জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রসমূহের স্থায়ী প্রতিনিধি, চলতি সাধারণ অধিবেশনের সভাপতি, নিউইয়র্ক সিটি মেয়রের প্রতিনিধিরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস তথা ভাষার জন্য বাঙালির অবিস্মরণীয় আত্মত্যাগের মহিমা নিয়ে আলোচনা করে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন একুশের শহীদদের। প্রতি বছরের ন্যায় ওয়াশিংটনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করে। সেখানে বিশ্বের প্রায় ২০টি দেশের সমন্বয়ে সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের ভাষা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি তুলে ধরা হয়। অংশগ্রহণকারী দেশগুলোও সংস্কৃতি ও কৃষ্টির ও তাদের আন্তরিক উদ্যমের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে নিবিড় বন্ধুত্বের কথাও তুলে ধরা হয়। ওয়াশিংটনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে বঙ্গবন্ধু অডিটরিয়ামে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর প্রতিনিধিদের স্বতঃস্ফূর্ত আগমন ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের উপস্থিতিতে এক নতুন উত্সাহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ভারত দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, নেপাল, রাশিয়া জার্মানি, মঙ্গোলিয়া, রুমানিয়া, বুলগেরিয়াসহ ইউরোপীয় অন্যান্য দেশ। আসুন, আমরা মুক্তির মন্ত্রে- আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত- আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি..... এই গান সমবেত কণ্ঠে গাইতে গাইতে আবহামান বাঙালির সংস্কৃতি, অসম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করে পায়ে পায়ে উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলি। লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক বর্তমান |