বুধবার ২৭ নভেম্বর ২০২৪ ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
প্রযুক্তির ছোঁয়ায় চাষাবাদে ভাগ্য বদলের স্বপ্ন
Published : Saturday, 18 February, 2017 at 6:00 AM, Count : 961

মোতাহার হোসেন : ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ এ প্রবাদ হাজার বছরের। আর এই মাছ ভাতের জোগান আসে আমাদের কৃষি থেকেই। দিন যত যাচ্ছে ততটাই ভোগবাদী মানুষের চাহিদা বাড়ছে ক্রমাগত। বাড়ছে দেশের জনসংখ্যা, বাড়ছে খাদ্য চাহিদা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য দিন দিন কমছে আবাদি জমি। তবুও আমাদের এই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যের চাহিদা মেটাচ্ছেন কৃষক। শুধু তাই নয়, চাহিদার উদ্বৃত্ত খাদ্য এখন বিদেশে রফতানি হচ্ছে। এর নেপথ্যে মূলত দেশে চাষাবাদে আদিম প্রথার বদলে এখন ব্যবহার হচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তি। এর ফলে কৃষিতে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সেকেলের কাঠের লাঙলের বদলে এখন ব্যবহার হচ্ছে ‘কলের লাঙল’ ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার প্রভৃতি। প্রযুক্তির ব্যবহারে ফলন বেড়েছে কয়েক গুণ। এ কারণে চাষাবাদে খরচ, শ্রম, সময় সবই কমেছে। আর বাড়ছে ফসল উত্পাদন, বদলাচ্ছে মানুষের ভাগ্যের চাকা, দেখা দিচ্ছে সৌভাগ্যের আলো। কৃষিতে সাম্প্রতিক বিপ্লব, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে এক অনন্য উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (ফাও) এ জন্য বাংলাদেশকে পুরস্কৃত করেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রায় সব কৃষকের কৃষিকাজে সেকেলে যন্ত্রপাতির বদলে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে আগ্রহ বাড়ছে। কেবল জমি চাষই নয়, জমিতে নিড়ানি, সার দেয়া, কীটনাশক ছিটানো, ধান কাটা, মাড়াই, শুকানো ও ধান থেকে চালসহ সবই আধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে করা হচ্ছে। বর্তমানে দেশের  মোট আবাদি জমির ৯০ ভাগ চাষ হচ্ছে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে। যত দূর জানা যায়, চীনে ২০২ থেকে ২২০ খ্রিস্টাব্দে মানুষ প্রথম লাঙল ব্যবহার করে জমি চাষ শুরু হয়। কাঠ দিয়ে লাঙল তারাই প্রথম তৈরি করে। লাঙলের ফলা তৈরিতে ব্যবহার করে লৌহদণ্ড। জোয়াল তৈরিতে ব্যবহার করত কাঠ। সেই থেকে কৃষি প্রযুক্তিতে প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন কৌশল ও যন্ত্রপাতি, কীটনাশক, সার বীজ প্রভৃতি। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় কৃষিতে যে বিপ্লব সাধিত হচ্ছে তা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা আল্লাহ মালুম।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে আশির দশকের শুরুতে কৃষিতে ধীরে-ধীরে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু হয়।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বিগত ৯-১০ বছর আগে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও কৃষি বিজ্ঞানীরা কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবনের কাজ হাতে নেন। বর্তমানে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ ধরনের আধুনিক যন্ত্রপাতি কৃষিকাজে ব্যবহার হচ্ছে। লাগসই প্রযুক্তির সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে কৃষিতে প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জন সম্ভব। বর্তমানে দেশে যেসব কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার হচ্ছে তার অন্যতম হচ্ছে কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার। এ যন্ত্রের মাধ্যমে ফসল কাটা, খোসা হতে ফসলের দানা আলাদা করার কাজ করা হচ্ছে। এছাড়া ছোট জমি চাষের জন্য পাওয়ার টিলার, বড় জমি চাষে ট্রাক্টর বা হুইল ট্রাক্টর, বীজ বপন, সার প্রয়োগ ও কীটনাশক ছিটানোর জন্য ব্রডকাস্ট সিডার, নির্দিষ্ট অবস্থানে বীজ বপনের জন্য সিড ড্রিল, গভীরভাবে কঠিন স্তরের মাটি কর্ষণের জন্য সাব ব্রয়লার, ধান/বীজ শুকানোর যন্ত্র ‘ড্রায়ার’, ধান, গম, ভুট্টা শুকানোর যন্ত্র ব্যাচ ড্রায়ার, পাওয়ার রিপার মেশিন (শস্য কাটার যন্ত্র), ঝাড়ার যন্ত্র ইউনারসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি চাষাবাদে ব্যবহার হচ্ছে। ইতোমধ্যে দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাওয়ার টিলার, পাওয়ার রিপার, ঝাড়ার যন্ত্র ইউনার, নিড়ানির যন্ত্র ইউডার, ধান ও গম মাড়াই কল, ভুট্টা মাড়াই কল ইত্যাদি যন্ত্রপাতি তৈরি হচ্ছে। সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নাটোর, বগুড়া, রংপুর, যশোর, শেরপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সেচপাম্প, ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলারের খুচরা যন্ত্রপাতি তৈরির বেশকিছু কারখানা গড়ে উঠেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে রীতিমতো বিপ্লব ঘটেছে। চাষাবাদে কাঠের লাঙলের ব্যবহার হয় না বললেই চলে। কৃষিকাজের মধ্যে সবচেয়ে শ্রমনির্ভর কাজ হচ্ছে বীজ বা চারা রোপণ, আগাছা দমন ও ফসল কাটা। মৌসুমের নির্দিষ্ট সময়ে বীজ বপন, চারা রোপণ এবং ফসল কেটে ঘরে তুলতে কৃষককে বেশ সঙ্কটে পড়তে হয়। ওই সময়ে কৃষি শ্রমিকের মজুরি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। কখনো কখনো দ্বিগুণ মজুরি দিয়েও কৃষি শ্রমিক পাওয়া যায় না। ফলে বিলম্বে বীজ রোপণের জন্য ফলন কম হয়, পোকা-মাকড় ও রোগ-বালাইয়ের আক্রমণ বৃদ্ধি পায়। তিনি বলেন, কখনো কখনো বিলম্বে ফসল কাটা ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে উত্পাদিত শস্যের একটি বড় অংশ নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া আগাম ফসল বিক্রি করতে না পারার কারণে প্রত্যাশিত মূল্য থেকেও কৃষক বঞ্চিত হন। এসব থেকে রক্ষা পেতেই কৃষিকাজে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে যেমন সময় কম লাগছে, তেমনি বেশি ফসলও উত্পাদন হচ্ছে। কৃষাণ দিয়ে এক বিঘা জমির ধান কাটাতে খরচ হয় তিন হাজার টাকা। আর ‘রিপার’ দিয়ে ধান কাটতে বিঘাপ্রতি খরচ হয় মাত্র ৫০০ টাকা। সময়ও লাগে কম। গরু দিয়ে হালচাষ করতে বিঘাপ্রতি খরচ হয় ৭০০ টাকা। আর পাওয়ার টিলার দিয়ে চাষ করতে খরচ হয় প্রতি বিঘায় ৪০০ টাকা। ট্রাক্টর দিয়ে হয় মাত্র ২৫০ টাকা। তাই তারা এসব আধুনিক যন্ত্র ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছেন। তবে এসব যন্ত্রপাতির দাম কমানো দরকার।
কৃষিবিজ্ঞানী ড. রাশিদ উল হক সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, দেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় চার কোটি টন খাদ্যশস্য উত্পাদিত হয়। উত্পাদন থেকে বাজারজাত পর্যন্ত প্রায় ১৫ শতাংশ খাদ্যশস্য বিনষ্ট হয়, যার পরিমাণ ৪৩ লাখ টন। অথচ চাষাবাদে পুরোপুরি আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে এসব সমস্যা দূর করা সম্ভব। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) মহাপরিচালক রফিকুল ইসলাম মণ্ডলের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরিতে ইনস্টিটিউটের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ প্রতিনিয়ত কাজ করছে।
বারি উদ্ভাবিত ‘পাওয়ার টিলার অপারেটেড সিডার’-এর উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, এই যন্ত্রটি দিয়ে একইসঙ্গে জমি চাষ, জমি লেভেল, সার ও বীজ দেয়া যায়। দিন দিন আমাদের জমি কমে যাচ্ছে, কিন্তু খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে। তাই কৃষিতে বিপ্লব ঘটাতে চাষাবাদের সব পর্যায়ে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দেন তিনি। তবে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় কৃষিতে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ও উন্নতি সাধিত হয়েছে তার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি দেশের তৃণমূলে এই খাতে জড়িত কৃষক, তরুণ উদ্যোক্তাদের এ প্রযুক্তি সম্পর্কে আপডেট ধারণা দেয়ার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে মাঠ পর্যায়ে সমন্বিতভাবে কাজ করবেন। আর এর তদারকি করতে হবে কৃষি মন্ত্রণালয়সহ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট উইংকে। এ ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠান কৃষকদের পাশে থেকে প্রযুক্তিগত ধারণা প্রদান, প্রশিক্ষণ, পরামর্শ, কৌশলগত সহযোগিতা অব্যাহত রাখবেন এ প্রত্যাশা থাকল।

লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক।



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : [email protected], [email protected]
Developed & Maintainance by i2soft