শিরোনাম: |
কানাডার আদালতের রায়
পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের প্রমাণ মেলেনি
|
বর্তমান প্রতিবেদক : পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পাননি কানাডার আদালত। কানাডার মন্ট্রিলভিত্তিক প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানের তিন কর্মকর্তাকে অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়েছে। অন্টারিও সুপ্রিমকোর্টের বিচারক ইয়ান নরডেইমার তার আদেশে বলেন, ‘অভিযোগের আবেদনের বিষয়ে তার ব্যাপক প্রশ্ন রয়েছে। এগুলোতে যেসব তথ্য দেয়া হয়েছে সেগুলো ‘অনুমানভিত্তিক, গালগল্প ও গুজবের বেশি কিছু নয়’। ফলে এসএনসি-লাভালিনের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেস, প্রতিষ্ঠানটির আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ শাহ ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডীয় ব্যবসায়ী জুলফিকার ভূঁইয়া এই মামলা থেকে অব্যাহতি পেলেন। একইসঙ্গে পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্তদের ২০১৩ সাল থেকে বিশ্বব্যাংকের কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষিত কানাডীয় প্রতিষ্ঠান এসএনসিকেও ‘নির্দোষ’ বলে উল্লেখ করেছেন ওই আদালতটি। অথচ ওই তিনজনের বিরুদ্ধে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজের ঠিকাদারি পেতে বাংলাদেশ সরকারের কয়েকজন কর্মকর্তাকে ঘুষ দেয়ার পরিকল্পনার অভিযোগ আনা হয়েছিল।
গত মাসে অন্টারিওর আদালতের বিচারক ইয়ান নরডেইমার এ মামলায় ষড়যন্ত্রের লিখিত তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপনে রুল জারি করেন। আদালতের নির্দেশে ফোনে আড়িপেতে ধারণ করা যেসব তথ্য আদালতে উপস্থাপন করা তা নিছক গুজব আর গুঞ্জন বলে প্রত্যাখ্যান করেন বিচারক। আসামিপক্ষের আইনজীবীর এক মুখপাত্র বলেছেন, আদালত পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের কোনো প্রমাণ পাননি। এজন্য আসামিদের খালাস দিয়েছেন। উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ নিয়ে নিজস্ব তদন্তে কোনো সত্যতা না পাওয়ায় ২০১৫ সাল থেকেই বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যাপকভাবে অর্থঋণ সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। এমনকি বশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে এসেও পদ্মা সেতুর কথিত ওই দুর্নীতির অভিযোগ সত্য ছিল না উল্লেখ করে বলেন, ‘বিশ্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রুল মডেল। বিশ্বব্যাংক এখন অতীতের দিকে না তাকিয়ে বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ উন্নয়নের সহযোগী হতে চায়।’ কানাডার গণমাধ্যম দ্য গ্লোব অ্যান্ড মেইলের খবরে বলা হয়, স্থানীয় সময় শুক্রবার কানাডায় অন্টারিওর একটি আদালত তাদের খালাস দিয়ে মামলাটি নিষ্পত্তি করেছেন। কানাডার একটি অনলাইন সংবাদপত্র ‘দ্য গ্লাব অ্যান্ড মেইল’ জানিয়েছে, অন্টারিও সুপিরিয়র কোর্টের বিচারক ইয়ান নরডেইমার এই আদেশ দিয়েছেন। এদিকে গতকাল শনিবার ফেসবুকে দেয়া এক স্ট্যাটাসে উল্লেখ করেন, ‘কানাডার একটি আদালত পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ দায়ের হওয়া মামলাটি খারিজ করে দিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে ফের প্রমাণিত হলো যে দুর্নীতির কথা বলা হয়েছিল, তা কেবলই গালগল্প ও গুজব ছিল।’ এর আগে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ২০১০ সালে তদন্ত শুরু করে। দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ২০১১ সালে পদ্মা সেতুর কাজ বন্ধ করে দেয় এর প্রধান অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংক। তাদের অনুরোধে কানাডার পুলিশ সে দেশের দুই নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এসএনজি ও লাভালিন ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। সাময়িক সংশয় ও ঝুঁকিতে পড়ে প্রকল্পটি। ২০১২ সালে কানাডার আদালতে এ ব্যাপারে অভিযোগ দায়ের করা হয়। রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশের (আরসিএমপি) করা ওই মামলায় পাঁচজনকে আসামি করা হয়। তবে দুই আসামি মহম্মদ ইসমাইল ও বাংলাদেশের সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন চৌধুরীর নাম আগেই মামলার নথি থেকে বাদ দেয় পুলিশ। খালাস পাওয়া তিন আসামির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে তাদের টেলিফোন আলাপের রেকর্ড সংগ্রহ করে আরসিএমপি। বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধেই ওই টেলিফোন কল রেকর্ড করা হয়। ওই টেলিফোন সংলাপে অভিযোগ প্রমাণ করার মতো কিছুই ছিল না বলে জানান বিচারক ইয়ান নরডেইমার। অন্টারিওর ওই বিচারক বলেন, ‘সেখানে (টেলিফোন রেকর্ডে) গল্প-গুজব ও সাধারণ কথাবার্তা ছাড়া কিছুই পাওয়া যায়নি। তদন্তে যা পাওয়া গেছে তা গুজব বা অভিযোগের বিপরীতে অকাট্য প্রমাণ হিসেবে ধরা যায় না। যা পাওয়া গেছে তা একটা গুজবের সঙ্গে আরেকটা গুজব মিলিয়ে তৈরি করা হয়েছে।’ ২০১০ সালে বিশ্বব্যাংক নিজেদের তদন্তে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আরসিএমপিকে অনুরোধ জানায়। এরই ভিত্তিতে আরসিএমপি, কানাডিয়ান নির্মাণ প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের কিছু কর্মকর্তার টেলিফোন সংলাপ রেকর্ড করার অনুমতি নেয়। পরে তারা এসএনসি-লাভালিনের কার্যালয়ে তল্লাশিও চালায়। ২০১২ সালে মোহাম্মদ ইসমাইল ও রমেশ শাহকে অভিযুক্ত করা হয়। পরে কেভিন ওয়ালেস ও বাংলাদেশি কানাডিয়ান ব্যবসায়ী জুলফিকার ভূঁইয়াকে এ মামলায় অভিযুক্ত করা হয়। ২০১৩ সালে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজে দুর্নীতির ঘটনায় এসএনসিকে ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। জানুয়ারিতে পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করে। মূল প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংক সরে যাওয়ার পর এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকা ও ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংকও প্রতিশ্রুত অর্থঋণ চুক্তি বাতিল করে। কিন্তু দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে দাতারা সরে যাওয়ার ঘোষণা দিলে জটিলতা তৈরি হয়। একপর্যায়ে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংকের পিছিয়ে যাওয়ার জন্য গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দায়ী করে চ্যালেঞ্জ করেন যে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নি। অভিযোগকারীকে দুর্নীতি প্রমাণ করতে হবে। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমগ্র বিশ্বকে তাক লাগিয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিলে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী পদ্মা সেতু হবেই ঘোষণা দিয়ে রাজস্ব খাত থেকে অর্থেরও বরাদ্দ করেন প্রধানমন্ত্রী। বিশ্বব্যাংক সরে যাবার পর নিজস্ব অর্থায়নে দেশের সর্ববৃহত্ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নেয় বাংলাদেশ সরকার। ২০১৪ সালে পদ্মা সেতু নির্মাণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সই করে সরকার। গত মার্চে নির্মাণকাজ শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। পদ্মা সেতুর নদীর মধ্যেকার কাজ করছে সিনো হাইড্রো করপোরেশন। চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি মূল সেতুর নির্মাণকাজ করছে। ইতোমধ্যেই পদ্মা সেতুর ৪০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে বলে গত জানুয়ারি মাসে সরেজমিনে গিয়ে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ২০১৮ সালে সেতু দিয়ে যুগপত্ভাবে যানবাহন ও ট্রেন চলাচল করবে- পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোতে থাকে। অনেক বাধাবিপত্তি ও ষড়যন্ত্র পার করে স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন সমাপ্তির দিকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ সংলগ্ন জেলা প্রশাসনকে বরাদ্দ দেয়া হয় এক হাজার ৭০ কোটি টাকা। ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে প্লট তৈরি করা হয়েছে ২ হাজার ৯৫টি। তার মধ্যে কিছু হস্তান্তরও করা হয়েছে। মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। দ্বিতলবিশিষ্ট এই সেতু নির্মিত হবে কংক্রিট আর স্টিল দিয়ে। ওপর দিয়ে যানবাহন আর নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন। মূল সেতু ও নদীশাসনের কাজ চার বছরের মধ্যে শেষ করার সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয় ঠিকাদারদের। পাশাপাশি অন্যান্য সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ কাজের জন্য সাড়ে তিন বছর সময় বেঁধে দেয়া হয়। |