শিরোনাম: |
৫২তম বিশ্ব ইজতেমা শুরু
স্মরণকালের বৃহত্তর জুমার নামাজের জামাত
শতাধিক দেশের মুসল্লির যোগদান: ৬ মুসল্লির মৃত্যু
|
টঙ্গী (গাজীপুর) প্রতিনিধি : টঙ্গীর তুরাগ তীরে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে ৫২তম বিশ্ব ইজতেমা। গতকাল শুক্রবার ফজরের নামাজের পর মাওলানা ওবায়দুল খোরশেদের আম বয়ানের মধ্য দিয়ে ইজতেমার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। অর্ধ-শতাধিক দেশের কয়েক হাজার মেহমান ছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ১৬টি জেলার মুসল্লিরা এই পর্বে অংশ নিচ্ছেন। মাওলানা ওবায়দুল খোরশেদ উর্দু বয়ানের বাংলায় অনুবাদ করেন বাংলাদেশের মাওলানা জাকিরুল ইসলাম। তাবলিগ জামাত আয়োজিত বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বে অংশগ্রহণের জন্য দেশি-বিদেশি মুসল্লিরা ইজতেমা ময়দানে এসে সমবেত হয়েছেন। শুক্রবার ভোর বেলায়ও অনেক মুসল্লিকে বিভিন্ন যানবাহনে চেপে ইজতেমা ময়দানে আসতে দেখা যায়। ইজতেমার প্রথম পর্বে দেশের ১৬টি জেলা থেকে আগত মুসল্লিরা ২৭টি খিত্তায় অবস্থান করে ভোর থেকেই বয়ান শুনছেন। অর্ধ-শতাধিক দেশের কয়েক হাজার বিদেশি মেহমান প্রথম পর্বে অংশ নিচ্ছেন। ইজতেমার নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত পরিমাণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। দেশব্যাপী জঙ্গি হামলা বিষয়টি মাথায় রেখে পাঁচস্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ প্রশাসন। গাজীপুরের জেলা পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ জানান, ইজতেমা মাঠের সার্বিক নিরাপত্তা রক্ষায় পাঁচস্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় প্রায় ৬ থেকে ৭ হাজার নিরাপত্তা কর্মী কাজ করছেন। পাশাপাশি সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে নিরাপত্তা মনিটরিং হবে। বাইনোকুলার, মেটাল ডিটেকটর, কন্ট্রোল রুম ব্যবহার করা হচ্ছে। ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের সুবিধার্থে ইজতেমা ময়দানের পাশে স্থাপন করা হয়েছে ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প। এ সব মেডিকেল ক্যাম্প থেকে ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের স্বাস্থ্যসেবা ও প্রয়োজনীয় ওষুধ দেয়া হচ্ছে বিনামূল্যে।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে হামদর্দ ল্যাবরেটরিজ (ওয়াকফ) বাংলাদেশের উদ্যোগে মেডিকেল ক্যাম্প উদ্বোধন করেন ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান। হামদর্দ ছাড়াও ইবনে সিনা, যমুনা ব্যাংক, র্যাবসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অর্ধশত মেডিকেল ক্যাম্প ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে। বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা ও প্রয়োজনীয় ওষুধ পেয়ে খুশি আগত মুসল্লিরাও। প্রথম পর্বে ৩ দিনের বিশ্ব ইজতেমা শুক্রবার শুরু হয়ে আগামীকাল রোববার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে। দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা শুরু হবে ২০ জানুয়ারি। এবার প্রথম পর্বের ইজতেমায় ঢাকাসহ ১৭ জেলার মুসল্লিরা অংশ নেবেন। শুরুর দিনই অনুষ্ঠিত হবে বৃহত্তম জুমার নামাজ। এবারের বিশ্ব ইজতেমার ময়দানে বিশাল চটের ছাউনি দেয়া হয়েছে। পুরো ইজতেমা ময়দানের চারপাশে প্রায় ১৬০ একর এলাকাজুড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পর্যাপ্তসংখ্যক সিসি ক্যামেরা স্থাপন করেছেন। মুসল্লিদের অংশ নেয়ার জন্য ইজতেমা ময়দানে জেলাওয়ারি ২৭টি খিত্তায় ভাগ করা হয়েছে। ১ থেকে ৫ নম্বর খিত্তায় ঢাকা জেলা, ৬, ৭ ও ৮নং খিত্তায় টাঙ্গাইল, ৯, ১০ ও ১১নং খিত্তায় ময়মনসিংহ, ১২নং খিত্তায় মৌলভীবাজার, ১৩নং খিত্তায় ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, ১৪নং খিত্তায় মানিকগঞ্জ, ১৫নং খিত্তায় জয়পুরহাট, ১৬নং খিত্তায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ১৭নং খিত্তায় রংপুর, ১৮ ও ১৯নং খিত্তায় গাজীপুর, ২০নং খিত্তায় বান্দরবান, ২১নং খিত্তায় রাঙামাটি, ২২নং খিত্তায় খাগড়াছড়ি, ২৩নং খিত্তায় গোপালগঞ্জ, ২৪নং খিত্তায় শরীয়তপুর, ২৫নং খিত্তায় সাতক্ষীরা, ২৬ ও ২৭নং খিত্তায় যশোর জেলার মুসল্লিরা অবস্থান নেবেন। পাঁচস্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা: গাজীপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. হারুন-অর-রশিদ জানান, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিশ্ব ইজতেমায় প্রথম পর্বের নিরাপত্তায় শক্ত অবস্থান নেয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি মাঠে থাকা বিজিবিও শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য মাঠে থাকা বিপুলসংখ্যক, পুলিশ, র্যাব, মহিলা র্যাব, আনসার ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা সার্বিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে। তিনি জানান, প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাঁচস্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে প্রায় ৬ হাজার সদস্য, র্যাব, ডিবি, গোয়েন্দা পুলিশ, আনসার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার আরও প্রায় ৬ হাজার সদস্যসহ মোট প্রায় ১২ হাজার সদস্য ইজতেমায় নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত থাকবেন। র্যাব মহাপরিচালক (ডিজি) বেনজীর আহমেদ জানান, টঙ্গী তুরাগপাড়ের বিশ্ব ইজতেমা মাঠের ১৮টি প্রবেশ গেটে সিসি ক্যামেরার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। প্রতিটি গেটে সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। সেই সঙ্গে বিদেশি মেহমান (অতিথিদের) নিবাসেও সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। তিনি জানান, বিশ্ব ইজতেমা চলাকালীন সময়ে মুসল্লিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের জন্য র্যাবের একটি কন্ট্রোল রুমসহ দুইটি সাব-কন্ট্রোল রুমে মাঠে স্থাপন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ইজতেমা মাঠে ৯টি অভজারভেশন পোস্ট, ৯টি ওয়ার্চ টাওয়ারের মাধ্যমে সবসময় পুরো মাঠ মনিটরিং করা হচ্ছে। র্যাবের একটি হেলিকপ্টার আকাশপথে পুরো ইজতেমা মাঠে পর্যবেক্ষণ করছেন। এছাড়া ইজতেমা মাঠের ভেতরে ও তার চারপাশ সিসি ক্যামেরার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। উত্তরা র্যাব-১ এর অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল তুহিন মোহাম্মদ মাসুদ জানান, ইজতেমার লাখো লাখো মুসল্লির নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে র্যাব সদস্যরা দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত আছে। ইজতেমার জন্য র্যাবের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, ডগ স্কোয়ার্ট, স্ট্রাইকিং ফোর্স, স্পিডবোট ও মোবাইল টহল টিম কাজ করছেন। তুরাগ নদীতে থাকবে র্যাবের স্পিডবোট। যে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ও আপদকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলায় র্যাব তত্পর আছে। ইজতেমায় বিপুলসংখ্যক র্যাব ও র্যাবের মহিলা সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন। আশা করছি কোনো অসুবিধা হবে না। ইজতেমায় মহিলাদের অংশগ্রহণ : টঙ্গী তুরাগ তীরে প্রথম পর্বের বিশ্ব ইজতেমায় আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে টঙ্গী, গাজীপুর, ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আসা হাজার হাজার মহিলা মুসল্লি এখন টঙ্গীতে এসে অবস্থান নিয়েছেন। তার মধ্যে অসংখ্য মহিলা মুসল্লি প্রতি বছরের ন্যায় টঙ্গী তুরাগপাড়ের পশ্চিম কোনে হাজি মনসুর আলীর বাড়িতে এসে অবস্থান গ্রহণ করেছেন। রোববার দিন ইজতেমা ময়দানের আশপাশে, বিভিন্ন মিলকারখানা, বাসা-বাড়িতে ও বিভিন্ন দালানের ছাদে বসে এসব প্রায় লক্ষাধিক মহিলা মুসল্লি আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণ করবেন। ২০ কিলোমিটারজুড়ে যানজট: প্রথম পর্বের তিন দিনব্যাপী ৫২তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথমদিন শুক্রবার ভোর থেকেই ইজতেমায় শামিল হতে ও পবিত্র জুম্মার নামাজ পড়তে ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ রাজধানী ঢাকা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলো থেকে ট্রেন, বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, জিপ, কার এবং নৌকাসহ নানা ধরনের যানবাহনে এবং পায়ে হেঁটেই ইজতেমা ময়দানে পৌঁছেন। শুক্রবার সকাল থেকেই দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে ইজতেমা অভিমুখে ছুটতে থাকে মুসল্লিদের কাফেলা। এতে তুরাগের তীরকে কেন্দ্র করে টঙ্গী গাজীপুর ময়মনসিংহ মহাসড়ক, টঙ্গী-সিলেট কালীগঞ্জ সড়ক, আব্দুল্লাহপুর সাভার-মিরপুর সড়কে প্রায় ২০ বর্গকিলোমিটারজুড়ে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে গোটা বিশ্ব ইজতেমা মাঠ পরিণত হয় এক বিশাল জনসমুদ্রে। ১৯৬৭ সাল থেকে নিয়মিত বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ১৯৯৬ সালে একই বছর দুইবার বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় ২০১১ সাল থেকে নিয়মিত দুইপর্বে বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন করা হচ্ছে। বিশ্ব ইজতেমায় ৬ মুসল্লির মৃত্যু বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে আসা মুসল্লিদের মধ্যে গতকাল শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ছয় মুসল্লি মৃত্যুবরণ করেছেন। সকাল ৯টার দিকে বাবুল মিয়া (৬০) নামে এক মুসল্লি হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। তিনি ফেনীর দাগনভূঁইয়া উপজেলার মাছিমপুর গ্রামের আ. রশিদের ছিলে। টঙ্গী সরকারি হাসপাতালের আবাসিক চিকিত্সক ডা. মোখলেছুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে মারা গেছেন সাহেব আলী (৩৫) নামে এক মুসল্লি। তার বাড়ি মানিকগঞ্জে। ওইদিন সকালে ময়মনসিংহের নান্দাইলের মারুয়া গ্রামের মৃত আহম্মদ আলীর ছেলে মো. ফজলুল হক (৫৬), বিকেলে সাতক্ষীরা জেলা সদরের খেজুরডাঙ্গা এলাকার মৃত আবদুস সোবাহানের ছেলে আবদুস সাত্তার (৬০) এবং সন্ধ্যায় টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার নিজবন্নী এলাকায় মো. জানু ফকিরের (৭০) মৃত্যু হয়। বুধবার রাতে মারা যান কক্সবাজারের মো. হোসেন আলী (৬৫)। তারা বার্ধক্যজনিত কারণে এবং হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বলে টঙ্গী সরকারি হাসপাতালের আবাসিক চিকিত্সক ডা. পারভেজ জানান। ইজতেমায় শতাধিক দেশের মুসল্লির যোগদান এবারের ৫২তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বে গতকাল শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ৬ হাজার ৮৮৭ জন বিদেশি মুসল্লি ইজতেমা ময়দানে এসে উপস্থিত হয়েছেন। গাজীপুর জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মো. মোমিনুল ইসলাম এ তথ্য জানিয়েছেন। এর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, মোজাম্বিক, নাইজেরিয়া, পানামা, মিসর, ওমান, সুদান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব-আমিরাত, কাতার, অস্ট্রেলিয়া, ব্রুনাই, কানাডা, কম্বোডিয়া, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, ইরান, জাপান, মাদাগাস্কার, মালি, সেনাগাল, দক্ষিণ আফ্রিকা, তাঞ্জেনিয়া, ত্রিনিদাদ, রাশিয়া, আমেরিকা, বেলজিয়াম, ক্যামেরুন, চীন, ফিজি, ফ্রান্স, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, কেনিয়া, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, সুইডেন, থাইল্যান্ড, তুর্কি, যুক্তরাজ্য, কোরিয়া, আলজেরিয়া, ইরাক, ফিলিস্তিন, কুয়েত, মরক্কো, কাতার, সোমালিয়া, সিরিয়া, তিউনিসিয়া, ইয়েমেন, বাহরাইন, জর্দান, মৌরিতানিয়া, দুবাইসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের মুসল্লিগণ রয়েছেন। ইজতেমার আয়োজক সূত্র জানিয়েছে, মুসল্লিদের এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। বিভিন্ন ভাষা-ভাষী ও মহাদেশ অনুসারে ইজতেমা ময়দানের উত্তর পাশে বিদেশি মেহমানদের জন্য পৃথক বিদেশি নিবাস নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। |