শিরোনাম: |
বড় ভাই
|
মো. আবু ইউসুফ : ভোরের শিশির ভেজা গ্রামীণ সরুপথ ধরে নিত্য সকালের ব্যায়াম করছেন আহমেদ সাহেব। প্রতিদিন তিনি ফজরের নামাজ শেষ করে প্রায় ২ কিমি. রাস্তা হাঁটেন। ডাক্তার বলেছে একদিনও বাদ দেয়া যাবে না এই হাঁটা, বাদ দিলেই বেড়ে যাবে শরীরে বাসাবাঁধা ডায়াবেটিস। তাই তিনি প্রতিদিন দুর্বাঘাসে মোড়ানো গ্রামের সরু রাস্তায় হাঁটাহাটি করেন। তার পদভারে দুর্বাঘাসে জমাট বাঁধা শিশির কণাগুলো ঝরে পড়ে। আহমেদ সাহেব সরকারি চাকরি ছেড়েছেন প্রায় ১০ বছর হলো এরও ২০ বছর আগ থেকেই তিনি এই হাঁটায় অভ্যস্ত। প্রায় ৩০ বছর আগে তার শরীরে ধরা পড়ে ডায়বেটিস নামের হাঁটাহাটির রোগ। প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও এখন আর খারাপ লাগে না বরং এখন তিনি এই হাঁটাকে উপভোগ করেন। সততার সাথে চাকরি জীবন শেষ করে নিজেকে কাজ থেকে অবসর না দিয়ে নতুন করে শুরু করেন ব্যবসায়িক কাজ। তখন অনেকেই তাকে নিষেধ করেন ব্যবসা না করে নিজেকে একটু বিশ্রাম দিয়ে বাকি জীবনটা কাটানোর। কিন্তু কে শোনে কার কথা। পাশের কথায় কান না দিয়ে তিনি ব্যবসায়িক কাজেই মন দেন। অবশ্য এর পেছনেও রয়েছে কারণ, আহমেদ সাহেব বিয়ে করেন বয়স পেরিয়ে, অবসর নেয়ার সময় তার বড় সন্তানের বয়স মাত্র ১৫ বছর আর ছোট সন্তানের বয়স মাত্র ১২ বছর। এক ছেলে এক মেয়ের ভবিষ্যত্ চিন্তা করেই হয়ত তিনি নিজেকে অবসরপ্রাপ্ত না ভেবে কর্মজীবী হিসেবেই রেখেছেন। সততার সাথে চাকরির জীবন কাটানো আহমেদ সাহেব ব্যবসা জীবনেও সততা বজায় রাখেন। তার সততার সুফলও ত্বর ত্বর করে বেড়ে উঠে। ডাল পালা গজিয়ে বটবৃক্ষের মতোই এখন তার সাথে এলাকার অনেককেই ছায়াদান করছে তার ব্যবসায়িক বটবৃক্ষ। এলাকার অসহায় গরিব মানুষগুলো তার কাছে যেন নিজের শরীরে সৃষ্ট একটি ক্ষত যার যন্ত্রণায় কাতর থাকেন তিনি। ক্ষত সারানোর জন্য যেমনি ওষুধপত্র দেয়া হয় তেমনি আহমেদ সাহেবও এলাকার অসহায় গরিব মানুষগুলোর দুঃখ-দুর্দশা সারানোর জন্য নিজের অর্জিত অর্থসম্পদের একটি অংশ তাদের জন্য নির্ধারিত করে রেখেছেন। শুধু তাই নয় আহমেদ সাহেব প্রতিটি পাড়া মহল্লায় ঘুরে ঘুরে দরিদ্র মানুষগুলোর একটি তালিকাও করে রাখেন। সে তালিকায় তিনি কখন কাকে কী সহযোগিতা করতে হবে এবং কার ঘরের চাল ডাল শেষ হবে, কার ছেলেমেয়ের স্কুল মাদরাসার বেতন দিতে হবে তাও তিনি নোট করে রেখেছেন। এলাকার এসব অসহায় দরিদ্র মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানোর জন্য তিনি প্রচার-প্রচারণাও করেন মাঝে মাঝে, তার দেখাদেখিতে এগিয়েও এসেছেন অনেকে এখন আর আহমেদ সাহেব একা নন। একাধিক আহমেদ সাহেব গড়ে তুলেছেন তিনি এখন ওনারা মোট ৭ জন এদের মাঝে দলনেতা হচ্ছেন আহমেদ সাহেব। তবে এই সাতজনের দল গড়ে তুলতে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে ওনাকে শুনতে হয়েছে অনেক কটুকথা কোনো কথায় কান দেননি তিনি আর তাই আজ তিনি সফল। এখন অনেকেই তার কাছে আসেন দলের সদস্য হতে অনুদান দিতে গরিবদের পাশে দাঁড়াতে এসব দেখে অনেক সময় ওনার চোখের জল গড়িয়ে পড়ে, বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস এযেন বৃদ্ধ বয়সে এভারেস্ট বিজয়। একদিন বিকেল বেলায় দোতলার বেলকনিতে শক্ত করে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে পশ্চিমে হেলানো লাল সূর্যটার দিকে তাকিয়ে আছেন আহমেদ সাহেব গভীর মনোযোগ দিয়ে কি যেন ভাবছেন। এসময় পেছন থেকে ডাক শুনে।
আরে দোস্ত তুই কোত্থেকে এলি? আহমেদ সাহেবের চাকরি জীবনের সবচাইতে কাছের বন্ধু যা বিনা সুতোয় বেঁধে রাখা বন্ধন, দুজনই অবসরে জীবন কাটানো লোক। অবসর নেয়ার পর মাঝে মাঝে দুজনের কথা হলেও দেখা হয়নি তাই আবেগে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে থাকেন অনেক্ষণ। আবেগ কাটিয়ে সোফায় বসতে বলেন বন্ধু নিজাম হায়দারকে যাকে সবসময় হায়দার বলেই ডাকতেন আহমেদ। হায়দার বস আমি চায়ের কথা বলছি একথা বলে ভেতরে গেলেন আহমেদ। আহমেদের পরিবার ধর্মীয় রীতি মানার কারণে কোনো মেহমানের সামনে আসেন না তার স্ত্রী এবং মেয়ে সেটি হায়দারও জানেন। তাই আহমেদ নিজে ভেতরে গিয়ে দুকাপ চা আর বিস্কেট নিয়ে আসেন। একটা চেয়ার টেনে হায়দারের সামনেই বসেন আহমেদ। এবার বল তোর ছেলেমেয়ে ভাবী ওরা কেমন আছে? ভালো আছে বন্ধু, তোর ছেলেমেয়েরা কেমন আছে। ভালো আছে ইনশাআল্লাহ। কথা বলতে বলেতে নামাজের সময় হয়ে যায়, নামাজ পড়ার উদ্দেশে বের হন দুজন। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর হায়দার তো অবাক এ সময় বেশ কয়েকজন লোক জড়ো হয়ে অপেক্ষা করছেন বাড়ির সামনে। আহমেদ সাহেব বের হওয়ার পর সমস্বরে সালাম, সালামের জবাব দিয়ে সবাই মিলে মসজিদের দিকে রওয়ানা দেন। বাড়ি থেকে একটু দূরেই মসজিদ সবাই মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষে সবাই আহমেদ সাহেবের বাড়ির উঠুনে জড়ো হন এসবের কিছুই বুঝতে পারছেন না হায়দার সাহেব শুধু ছেয়ে ছেয়ে দেখছেন প্রশ্ন করার সময়ও পাচ্ছেন না তিনি। দুটি চেয়ার টেনে বসেন আহমেদ এবং হায়দার সাহেব তাদের দুজনের সামনেই সবাই বসে আছেন, সবার মাঝে নীরবতা। নীরবতা ভেঙে একজন দাঁড়িয়ে সবার উদ্দেশে সালাম দিয়ে বললেন প্রিয় উপস্থিতি আজ আমরা এখানে একসাথে হয়েছি একটা উদ্দেশ্য নিয়ে আর সেটি হচ্ছে... চুপ করলেন কেন আরেকজন বলে উঠল। বলছি আজ আমাদের বড় ভাই আহমেদ সাহেবের জন্য একটি বিশেষ দিন সে দিনটি সবাই মিলে উদযাপন করব বলেই আমরা এখানে সমবেত হয়েছি। এ কথা শুনে হায়দার সাহেব তাকালেন আহমেদের দিকে আর আহমেদ তাকালেন হায়দারের দিকে এবং মুখ আর হাতের ইশারায় জিজ্ঞেস করলেন কী উদযাপন। প্রিয় ভাইয়েরা আমরা প্রথমে আমাদের বড় ভাইয়ের সুস্বাস্থ্য কামনা করছি যেন উনি আমাদের মাঝে চিরকাল বেঁচে থাকেন এবং ওনার সাথে আমাদের অসহায় মানুষগুলো দুঃখ-কষ্ট থেকে কিছুটা হলেও পরিন্ত্রাণ পায় এজন্য আমার ওনার সুস্থতা কামনা করছি। কী বলেন আপনারা? সবার উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়লেন উপস্থাপক, তার প্রশ্নের সাথে সাথে উপস্থিত সবাই সমস্বরে বলে উঠলেন অবশ্যই অবশ্যই। আমরা তো বড় ভাইয়ের জন্যই ভালো আছি। এ কথা শুনেই আহমেদ সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললেন না আপনারা ভুল বলছেন আমার কোনো ক্ষমতা নেই আপনাদের ভালো রাখা? বরং আপনাদের যিনি ভালো রাখেন তিনি আমাকেও ভালো রাখেন অতএব কখনো এ রকম ধারণা করবেন না। আর আসলে আমি এতক্ষণ পর্যন্ত দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম। আজ এ সময় আপনার কেন আমার বাড়িতে জড়ো হলেন এখন আমার মনে পড়ে আজ আমার জন্মদিন। একথা শুনে সবাই জী বড় ভাই আজ আপনার জন্মদিন। আমরা জানি আপনি এসব মনে রাখেন না তাই আমরা কয়েকজন মিলে আপনাকে চমকে দেব বলেই আজ সবাই একসাথে আসা। এ কথা শুনে আহমেদ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। আপনারা আমাকে এতো ভালোবাসেন? আমার জন্মদিনের তারিখ মনে রাখেন? সত্যি আমি অনেক ভাগ্যবান অনেক ভাগ্যবান। আপনাদের মতো পড়শি পেয়ে আমি ধন্য আপনাদের ভালোবাসার কোনো মূল্য হয় না আমি আপনাদের কাছে চিরঋণী। না বড়ভাই আপনি না আমরাই আপনার কাছে সবচাইতে বেশি ঋণী আপনার ভালোবাসার কাছে পৃথিবীর সব ভালোবাসা তুচ্ছ, আপনার আদরের কাছে সব আদর মূল্যহীন, আপনার আকাশের মতো হূদয়ের কারণে আমাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন অবহেলিত সমাজে আলোর ঝলকানি আপনার মতো বড়ভাই পেয়ে সত্যি আমরা ধন্য। এতক্ষণ চুপ ছিলেন হায়দার আর যেন চুপ থাকতে পারলেন না দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরলেন আহমেদকে অনেক্ষণ ধরে রাখলেন। হায়দারের সাথে উপস্থিত সবাই দাঁড়িয়ে গিয়ে করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানালেন বড় ভাইকে। অভিনন্দন জানিয়ে বিদায় নিবে সবাই এ সময় আহমেদ সবাইকে ডাক দিয়ে বললেন, আগামীকাল দুপুরে আপনাদের সবার দাওয়াত রইল। দুপুরে আমরা সবাই একসাথে খাব এই বলে সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় করলেন সেদিনের মতো। কিরে এভাবে কী দেখছিস ঘরে চল। আহমেদের কথায় সম্ভিত পিরে আসে হায়দারের বড় ভাই। কিরে তুইও দেখি বড়ভাই শুরু করলি। না শুরু করে উপায় আছে সত্যিই তুই বড় ভাই! আরে চল দুজনে রুমে গিয়ে হায়দারকে সোফায় বসিয়ে। তুই বস আমি চা বানিয়ে নিয়ে আনছি। একথা বলে বড় ভাই ভেতরে গিয়ে দুকাপ চা আর বিস্কেট নিয়ে হায়দারের পাশে সোফায় বসে। চা খেতে খেতে দুই বন্ধুর মাঝে গল্প শুরু হয়। প্রথমেই হায়দার জানতে চায় আহমেদের অবসরকালীন দিনগুলো কাটানো এবং বড় ভাই হয়ে উঠার গল্প... দুই আহমেদ নিচের দিকে তাকিয়ে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে, যেন যোগব্যায়ামে মগ্ন সে। - কিরে এভাবে কী ভাবছিস শুরু কর। আর বলতে না চাইলে থাক। হায়দারের ডাকে সম্ভিত পিরে আসে আহমেদের, দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে। আচ্ছা দোস মাঝে মাঝে তোর এই দীর্ঘশ্বাস! আমি অনেকবার তোকে জিজ্ঞেস করতে ছেয়েছিলাম কিন্তু সময় হয়নি কারণটা কী বলবি? - শুনবি? - তুই বলে দেখ না শুনি কি-না, তুই জানিস তোর লুকানো সব শোনার জন্য যে কয়দিন সময় লাগবে সেকয়দিন আমি এখানে থাকব। - সত্যি বলছিস। - একশ সত্যি এবার তুই শুরু কর। আহমেদ তার সুখ, দুঃখ গাঁথা না বলা কথাগুলো। আমাদের সংসারটা ছিল ছোট পরিবারের, দাদা দাদুকে আমি দেখেনি অথাত্ আমার জন্মের আগেই ওনারা দুনিয়া ত্যাগ করেন। - ওপ কী মিস করলি তুই, দাদা দাদু কী জিনিস যে পেয়েছে সেই বুঝতে পারে। - হ্যাঁ আমার কপালে দাদা দাদুর আদর ভালোবাসা জোটেনি। জানিস আমার দাদু নাকি অনেক সুন্দরী ছিল, তবে একটু সহজ সরল ছিল। মা বলতেন আমার দাদু কথায় কথায় রাগ করতেন মাঝে মাঝে মায়ের গায়ে নাকি হাতও তুলত কিন্তু পরক্ষণেই তা ভুলে যেতেন। - তাহলে তোর দজ্জাল মার্কা দাদু ছিল? - আরে না দাদু একটু বেশি সহজ-সরল ছিল এর জন্য দাদুর একটা সংসারও ভেঙে যায়। - সংসার ভেঙে গেছে মানে? - মানে আমার দাদার সাথে বিয়ে হওয়ার আগে দাদুর আরেকটি বিয়ে হয়। দাদুর সে সংসারে ছেলেও ছিল একটা কিন্তু দাদুর সহজ সরলতার কারণে সেই সংসারটা ভেঙে যায়। - খুব মজার ব্যাপারতো! আচ্ছা তোর দাদুর ওই ছেলের সাথে তোদের সম্পর্ক আছে? - আছে মানে বাবা আর উনিত আপন ভাইয়ের ছেয়েও বেশি। - তাই নাকি। - হ্যাঁ এখনো আমাদের আর ওই বড় চাচার মাঝে আপনের মতো সম্পর্ক বাবা আর চাচা দুজনেই ভাইয়ের মতো সম্পর্ক রাখে। কখনো তাদের মাঝে সত্ ভাইয়ের আচরণ দেখেনি। আচ্ছা তুই আমার পেটের সব জেনে খোটা দিবিনাতো। - দেখিস আবার কখনো বলিসনা আমার দাদুর দুই বিয়ে হয়েছে তাহলে বাকিটা আর বলব না। - বলার আর কী বাকি আছে, আচ্ছা তোর দাদা কয় বিয়ে করেছেন? - দাদাও দুই বিয়ে করেছেন। - তাহলে তোর দাদা দাদু দুজনই দুই নম্বর, একথা বলেই হেসে উঠে হায়দার। - খবরদার এভাবে বলবি না। - ঠিক আছে আর বলব না, আচ্ছা দুই দাদু কী একসাথে ছিল। - না প্রথম দাদু মারা যাওয়ার পর দ্বিতীয় দাদুকে বিয়ে করেন। - এজন্যই বলি..... - খবরদার আমার দাদা দাদু সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করবি না - না করব না তবে তুই যে একটায় রয়ে গেলি.... একথা বলেই দুই বন্ধু হাসিতে মেতে উঠে এ যেন বাঁধভাঙা হাসি, হাসতে হাসতে দুজনেরই কাশি চলে আসে। - বল বন্ধু আজ সারারাত তোর গল্প শুনব। - শুনবিত? - হ্যাঁ শুনব, চা একটু বেশি খেতে হবে এই আর কি। - আমরা দুই ভাই বোন আর বাবা মা, বাবা ছোট খাটো ব্যবসা করতেন তা দিয়ে সুন্দরভাবে আমাদের সংসারটা চলে যেত। প্রতিদিন ভোর হলেই বাবা বাজারে দোকানের উদ্দেশে বের হতেন আর দুপুর হলে বাড়িতে ফিরতেন। আর বাড়িতে এসে আমাদের দুই ভাই বোনকে পাশে বসিয়ে দুপুরের খাবার খেতেন। বাবার হাতের টমেটো মাখা জোলের মাখানো আর কাঁটা ছড়ানো মাছে ভর্তি ভাতের লোকমা ওপ কিযে স্বাদ এখনো মনে হলে জিবে পানি চলে আসে। আর খাওয়ার পর বাবার বিছানায় এলিয়ে দেয়া শরীরে আমাদের দুজনের লাফালাফি, বাবার চুল ধরে টানা টানি, মাঝে মাঝে ভাই বোনের মাথায় মাথায় বাড়ি খাওয়া আবার খাটের কোনায় পড়ে গিয়ে আঘাত পাওয়া এর সাথে মায়ের মিষ্টি বকুনি সেকি আনন্দ ভাষায় বুঝিয়ে প্রকাশ করার নয়। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে হায়দার বললো - ঠিকই সে দিনের কথাগুলো মনে হলে নিজেকে সেদিনের মাঝে হারিয়ে পেলি। মায়ের কাছে বিভিন্ন বায়না ধরা, বাবা বাজারে যাওয়ার সময় আবদারের তালিকা প্রকাশ করা, সেগুলো না আনলে ক্ষণিকের জন্য রাগ করা, এটা ওটা ভেঙে পেলাসহ কত অকাজ তাই না? - হ্যাঁ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আহমেদ আবার শুরু করে সে - আমার আপু আমার থেকে বয়সে ৩ বছরের বড় বাবা মা মাঝে মাঝে আমাদের দুজনকে কোলে নিয়ে বলতেন আমার সোনার সংসার এ সোনার সংসার যেন আজীবন সুখের থাকে। বাবা মা যখন সোনার সংসার বলে কথা বলতেন তখন বাবা মায়ের মুখে চাপা কষ্টের ছাপ দেখা যেত। এ কথা শুনে হায়দার বললো কেন কিসের কষ্ট। - আমি খুব ছোট বয়স ৪/৫ বছর হবে এ বয়সেও কথা বলতে শিখিনি। - এ বয়সেও কথা বলিসনি তুই? - না কথা বলতে পারতাম না এজন্য অনেকেই আমাকে বোবা বলে ডাকতো। - তার পর? - সবার সাথে আকার ইঙ্গিতে কথা বলতাম। - তোর সে ইঙ্গিতের কথা সবাই বুঝতো? - না সবাই বুঝতো না শুধু বাবা মা বুঝতেন এনিয়ে বাবা মা আত্মীয়-স্বজন মনে খুব কষ্ট অনুভব করতেন তারা ভাবতেন আমি হয়ত কোনোদিন কথা বলতে পারব না। - তোকে কোনো ডাক্তার দেখান নি? - হ্যাঁ এজন্য অনেক ডাক্তার কবিরাজও দেখিয়েছেন। - ডাক্তার তখন কী বলেছিল? - আমাদের গ্রামের এক ডাক্তার পরামর্শ দিলেন আমার জিহ্বার নিচের কালো রগটি কেটে দিলে কথা বলতে পারব। - তার পর? - কিন্তু কোনো নিশ্চয়তা দেননি তিনি, আর রগ কাটাও হয়নি। অবশ্য ডাক্তারের এ পরামর্শ শুনে আমার এক মামা মায়ের পুপাতো ভাই বললেন। তোরা এতো হাহুতাশ করিস না ও একদিন কথা বলবে। - আচ্ছা আচ্ছা তার পর? -মামার সে কথা শুনে সাময়িক শান্তনা পেতেন বাবা মা কিন্তু দুশ্চিন্তা কাটত না। বাবা মায়ের বড় ছেলে হওয়ার কারণে হয়তো একটু বেশিই চিন্তা করতেন তারা। ছেলের মুখে বাবা আর মা ডাক শুনতে সবাই চায় আমার বাবা মাও তাই চাইতেন বলে আমার জন্য তাদের বাড়তি চিন্তা করতেন। আর আমার বড় বোনও আপু ডাক শোনার জন্য পাগল ছিল। সারাদিন আগলে রাখত আমাকে আর একটু পর পর বলতো ভাই আমাকে আপু বল। তার বলার ভঙ্গিমায় আমিও শত চেষ্টা করতাম কিন্তু পারতাম না। এতে আপু অনেক সময় কেঁদে দিত তার চোখে পানি দেখে আমার চোখেও পানি চলে আসত। ভাই বোন মিলে একে অপরের চোখের পানি মুছে দিতাম এছাড়া যে আর করার কিছুই ছিল না। কিছু দিন পর আপু অসুস্থ হয়ে পড়ল শরীর কাঁপানো জ্বর কোনো ওষুধে সে জ্বর কমেনা এলাকার সব ডাক্তার দেখিয়ে জ্বর কমানো যাচ্ছে না। অজপাড়া গাঁয়ে বড় কোনো ডাক্তার না থাকায় শনাক্ত করা যায়নি জ্বরের কারণ। - কোনো হাসপাতালে নেয়নি? - হাসপাতাল? তখন আমাদের এলাকাটা ছিল অবহেলিত রাস্তাঘাটের অবস্থা এতই খারাপ ছিল যে মানুষ পায়ে হাঁটাও ছিল কষ্টকর। কোনো যানবাহন না থাকায় গ্রামের লোকজন পায়ে হেঁটে দূর দূরান্ত যাতায়াত করতো, আর বর্ষার শুরুতেই গ্রামীণ রাস্তাগুলো পানিতে তলিয়ে যেত রাস্তাঘাট বলতে কিছুই ছিল না। ছিল না ভালো কোনো ডাক্তার কেউ অসুস্থ হলে ভালো কোনো ডাক্তারের চিকিত্সা নিতে পারেনি তারা। চিকিত্সার অভাবে অজপাড়া গাঁয়ের এসব নিরক্ষর মানুষগুলো অকালে জীবন হারিয়েছেন। - বলিস কী? - হ্যাঁ আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে ছিল হাসপাতাল, যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত না হওয়ায় কোথাও নিয়ে ভালো কোনো ডাক্তার দেখানো সম্ভব হয়নি। দিন দিন আপুর শরীর খারাপের দিকে চলে যায় নিস্তেজ হয়ে পড়ে শরীর বাবা মা সারক্ষণ আপুর বিছানার পাশে বসে আল্লাহকে ডাকা আর কান্না করে দিন কাটায়। আমার প্রতিও তাদের অযত্ন দেখা দেয়। একদিন আপু বমি করে প্রচুর, বমির সাথে বের হয় রক্ত আর পুজ এসব দেখেত বাবা মা বেহুশ তখন আপুকে বাবা মা গ্রামের সব চাইতে বড় ডাক্তারের নিকট দ্বিতীয়বারের মতো নিয়ে গেলেন। - তার পর। - ডাক্তার আপুকে দেখে বললেন তার টনসিল হয়েছে এবং টনসিল পেকে ফেটে গেছে তাই রক্ত আর পুজ বের হয়। - ডাক্তার কোনো চিকিত্সা দেননি? - না এজন্য ডাক্তার কোনো চিকিত্সা দেননি নিরুপায় বাবা মা আপুকে নিয়ে বাড়িতে চলে আসেন। সুনসান নীরবতা অনেক্ষণ কথা নেই আহমেদের মুখে শুধু হাত দিয়ে বার বার চোখ মোছার চেষ্টা করে। কিন্তু চোখ থেকে পানি পড়া বন্ধ করা যায় না। উপরের দিকে তাকিয়ে থাকে অনেক্ষণ যেন প্রচণ্ড ব্যাথায় কুকড়ে উঠে পুরো শরীর। হায়দারের চোখেও পানি চলে আসে গড়িয়ে পড়ে কপল বেয়ে আহমেদকে জড়িয়ে ধরে মুখে কোনো কথা বলতে পারছে না সে দুজনই নির্বাক বসে থাকে অনেকক্ষণ, এরপর আবার শুরু করে আহমেদ। - আপুর এ অবস্থা দেখে আমার খুব কষ্ট হতো কিন্তু কিছুই বলতে পারতাম না। বার বার আপু বলে ডাকার চেষ্টা করতাম বার বার করতাম আপুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতাম। আপু তখন বন্ধ দুটি চোখ মেলে আমার দিকে তাকানোর চেষ্টা করত আর যেন বলত ভাই আমাকে তুই আপু বলে ডাকবি না? তোর আপু ডাক আমি শুনতে পারব না। একথাটি মনে হলে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতাম সবার আড়ালে বসে কাঁদতাম আর চেষ্টা করতাম আপু বলে ডাকি কিন্তু পারতাম না। আহমেদের গলা বন্ধ হয়ে আসে চোখের কোনায় পানি জমে ঝাপসা হয়ে আসে দুই চোখ। চোখ থেকে পানি মোছার চেষ্টা করে আহমেদ। কথা বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে, হাত দিয়ে চোখ মুখ ঢেকে সোফায় হেলান দিয়ে বসে থাকে সে। এ অবস্থা দেখে হায়দারও আবেগ ধরে রাখতে পারেনি তার চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে। অনেকক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে আবার শুরু করে আহমেদ। - আপুর এ অবস্থায় পাড়ার লোকজন সারাক্ষণ আসা যাওয়া করতো কারণ আমাদের পাড়ায় আপু ছিল খুবই সুন্দর তার মাথার চুলগুলো ছিল অনেক লম্বা। চেহারা চুল আর শরীরের গঠনে আপু ঠিক পরীর মতোই সুন্দর ছিল তাই অনেইে আপুকে পরীমনি বলে ডাকতো। তাই পাড়ার মহিলারা সকাল বিকাল এসে একবার দেখে যেত আর আপসোস করত, তাদের আপসোসে বাবা মা আরো হতাশ হয়ে পড়তেন মা-তো সারাক্ষণ আল্লাহকে বলতেন আপুকে যেন সুস্থ করে দেন। আর নিয়ত মানতের শেষ ছিল না মায়ের। একদিন সেদিনটি ছিল মঙ্গলবার পড়ন্ত বেলা বাবা বাজারে গেছেন দোকানে এ অবস্থায় আপু কেমন যানি করছে। আপুর অবস্থা দেখে সবাই কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। সবার কান্নাকাটি দেখে আমি বাজারের দিকে দৌড় দেই কিছুদূর গিয়ে আবারও পিরে আসি। এসে দেখি আপুকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে মা উপস্থিত সবাই কাঁদছেন। কয়েকজন মিলে আপুকে মায়ের কোল থেকে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে সাদা কাপড়ে ঢেকে দিলেন তখন বুঝলাম আপু আর আমাদের মাঝে নেই। আমাকে আর কেউ আপু বলে ডাকার জন্য বায় না ধরবেনা, আপু ডাক শোনার জন্য আদর করবে না। তখন উপস্থিত সবাই মাকে শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু কোনো শান্তনাই মায়ের কান্না থামছে না। এদিকে আপুর এ সংবাদ শুনে বাবাতো দোকানেই অজ্ঞান। আপুর সেই মৃত্যু আর আমার আপু ডাক না বলা আজো আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়, মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারিছ না সারাক্ষণ কানে বাজে আপুর সেসব বায়নার কথা আর সে সব মনে হলে নীরবে লুকিয়ে কাঁদি।... |