শিরোনাম: |
সরকারের সাফল্যের ৩ বছর
অর্থনীতিতে সাফল্য ছিল ঈর্ষণীয়
|
রহমান আজিজ : মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরের স্বপ্ন নিয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে আরও এক বছর পার করেছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার। বিদায়ী এ বছরে দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ করে জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, রিভার্জ, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানো, ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী ব্যাংক ঋণের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা, বিদেশি শ্রমশক্তি রফতানি, পণ্য রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধি, শেয়ারবাজারকে ইতিবাচক ধারায় ফেরানো, রাজস্ব আদায়ে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি এবং ওষুধ রফতানিসহ সব মিলিয়ে সরকারের উন্নয়ন-অগ্রগতি ছিল চোখে পড়ার মতো। অর্থনীতির প্রায় সবগুলো সূচকই ছিল ঊর্ধ্বমুখী।
জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে সরকারের সফলতার বছর ছিল এটি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতা বজায় ছিল বিদায়ী বছরেও। দেশের মোট দেশজ উত্পাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি এখন ৭ শতাংশের উপরে। ২০১৬ সালেই এই মাইলফলক অর্জন করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখত, দেশের জিডিপি ৭ শতাংশ পার হবে। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিষয়টি সম্ভব হয়েছে। এমনকি চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাও ৭ শতাংশের বেশি ঠিক করা হয়েছে। গত ২৫ অক্টোবর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জিডিপি সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপির পরিমাণ ৭ দশমিক ১১ শতাংশ, যা গত ছয় বছরের জিডিপি বিবেচনায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উজ্জ্বল এক নিদর্শন। আগের দুই অর্থবছরে অর্জিত জিডিপি ছিল যথাক্রমে ৬.৬ এবং ৬.৫৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির কারণে বিদায়ী এ বছরে স্বস্তিতে ছিল সরকার। বছরজুড়েই মূল্যস্ফীতি মোটামুটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল। গেল নভেম্বর শেষে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ, যা আগের মাস অক্টোবরে ছিল ৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ। বছরের শুরু অর্থাত্ জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতির এ হার ছিল ৬ দশমিক ০৪ শতাংশ। চলতি বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল থাকায় এবং বেশিরভাগ ভোগ্যপণ্যের মূল্য স্থিতিশীল থাকায় মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। আর চলতি অর্থবছর শেষে, অর্থাত্ জুন-২০১৭ শেষে মূল্যস্ফীতির চাপ ৫ দশমিক ৮ শতাংশের মধ্যেই থাকবে বলে বাজেট বক্তৃতায় ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ২০১৬ সালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আগের যে কোনো সময়কে ছাড়িয়ে গেছে। সব রেকর্ড ভেঙে নভেম্বর শেষে বাংলাদেশে ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলারের রেকর্ড ছুঁয়েছে, যা এক বছর আগে অর্থাত্ নভেম্বর-২০১৫-তে ছিল ২৭ দশমিক ০৫৮ বিলিয়ন ডলার। সেই হিসাবে এক বছরে রিজার্ভ বেড়েছে ৪ দশমিক ৮৩৭ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান রিজার্ভ সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। রিজার্ভের দিক দিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান, যা পাকিস্তানের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। শেয়ারবাজারকে ইতিবাচক ধারায় ফেরানো সরকারের একটি বড় সফলতা। দীর্ঘদিনের মন্দাভাব ও আস্থার সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে দেশের শেয়ারবাজার। সদ্যসমাফত ২০১৬ সালে এসে ধস-পরবর্তী পাঁচ বছরের হতাশা কাটিয়ে ইতিবাচক ধারায় ফেরে শেয়ারবাজার। শেয়ারদর ও সূচকে ফিরে এসেছে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা। লেনদেনেও গতি ফিরে আসছে। সব শ্রেণির বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির সুবাদে ২০১৬ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ ও দৈনিক গড় লেনদেন বেড়েছে প্রায় ৭২ কোটি টাকা। বাজার পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ২০১৬ সালে ৪ হাজার ৬০০ পয়েন্টের ঘরে যাত্রা করে ডিএসইএক্স। প্রথম চার মাসের নিম্নমুখী প্রবণতায় ২ মে সূচকটি ৪ হাজার ১৭১ পয়েন্টে নেমে আসে। তবে শেয়ারবাজারে ব্যাংকের অতিরিক্ত বিনিয়োগ সমন্বয়কে কেন্দ্র করে বিনিয়োগকারীদের সব ভীতি দূর করতে বাস্তবসম্মত পদ্ধতি অবলম্বন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি অর্থনীতি, ইন্ডাস্ট্রি ও তালিকাভুক্ত কোম্পানির আয়ও তাদের আশ্বস্ত করে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে নগদ লভ্যাংশ দেয়ার প্রবণতাও আগের বছরের তুলনায় বাড়ে। সব মিলিয়ে কয়েক দফা মৃদু সংশোধনের মধ্যদিয়ে শেষ পর্যন্ত ৫ হাজার ৩৪ পয়েন্টে বছর শেষ করে ডিএসইএক্স, যা প্রায় আড়াই বছরের সর্বোচ্চ। দেশের শেয়ারবাজারে বিদেশিদের বিনিয়োগ বাড়ছে। আগে বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ারে বিদেশিদের বেশি আগ্রহ ছিল। এখন দেশীয় কিছু কোম্পানিতে সর্বাধিক বিনিয়োগ তাদের। প্রতি মাসেই এ বিনিয়োগ বাড়ছে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে ইতিবাচক দিক দেখা যাচ্ছে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরের শেষে দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৮৮টি কোম্পানিতে বিদেশিদের মোট বিনিয়োগ ছিল বাজারদরে ৯ হাজার ১৩২ কোটি টাকা। গত নভেম্বর শেষে ১১৪ কোম্পানিতে বিদেশিদের মোট বিনিয়োগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকায়। অর্থাত্ গত ১১ মাসে বাজার মূল্যে বিদেশিদের পোর্টফোলিও বিনিয়োগ বেড়েছে ৬ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা বা প্রায় ৭২ শতাংশ। ডিএসইতে প্রকাশিত বিভিন্ন কোম্পানিতে বিদেশি শেয়ারের হিসাব গণনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে কৃৃষিজ উত্পাদন বাড়ানোর পাশাপাশি মানবসম্পদ রফতানির পথ খুঁজে নেয় বাঙালি জাতি। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় ১৯৭৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় মানবসম্পদ রফতানি। সে বছরে বিশ্বের সাতটি দেশে চাকরির জন্য যান ৪ হাজার ৬৯১ জন। এর মধ্যে সৌদি আরবে ২১৭, আরব আমিরাতে ১ হাজার ৯৮৯, কুয়েতে ৬৪৩, ওমানে ১১৩, কাতারে ১ হাজার ২২১, বাহরাইনে ৩৩৫ ও লিবিয়ায় ১৭৩ জন শ্রমিক পাঠানো হয়। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় বলছে, জানুয়ারি-২০১৬ থেকে ডিসেম্বর-২০১৬ (৬ তারিখ পর্যন্ত) ৭ লাখেরও বেশি শ্রমিককে বিদেশে পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ২ কোটি বাংলাদেশি কর্মরত, যাদের পাঠানো রেমিট্যান্সে গড়ে উঠছে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এর ৮০ ভাগেরও বেশি শুধু প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স। বাকি অর্থ এসেছে অন্যান্য পণ্য রফতানি খাত থেকে। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণমান এখন অনেক উন্নত ও শক্তিশালী। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশ গড়তে শক্তিশালী এ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও অনন্য ভূমিকা রাখছে। এ ক্ষেত্রে প্রবাসী শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ শ্রমিক হিসেবে গড়ে তুলতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জনের পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচনের পথেই হাঁটছে বাংলাদেশ। গেল বছরের অক্টোবর প্রকাশিত সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বর্তমানে তিন কোটি ৭৬ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। যা দেশের মোট জনসংখ্যার সাড়ে ২৩ শতাংশ। এর মধ্যে এক কোটি ৯৪ লাখ মানুষ অতি দরিদ্র। প্রতিবেদনের পরিসংখ্যানে জানানো হয়, ২০০৯ সালের চেয়ে বর্তমানে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটেছে। সেই সময়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল পাঁচ কোটি এবং অতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল দুই কোটি ৮০ লাখ। মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছাতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। যেটি এ সরকারের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল। মাথাপিছু বার্ষিক আয় এক হাজার ৪৬৫ ডলারে পৌঁছে যাওয়ায় গত বছর জুলাই মাসে বিশ্বব্যাংক তাদের তালিকায় বাংলাদেশকে নিম্ন মধ?্যম আয়ের দেশের কাতারে তুলে এনেছে। বিশ্বব?্যাংকের হিসাবে বাংলাদেশে ‘অতিদরিদ্র’ মানুষের সংখ?্যা এখন মোট জনগোষ্ঠীর ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। অর্থাত্, ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে (পারচেজিং পাওয়ার পেরিটি) বাংলাদেশের ১২ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষের দৈনিক আয় ১ দশমিক ৯ ডলারের (১১৫ টাকা) কম। এই হার ভারত, পাকিস্তান ও ভুটানের চেয়েও ভালো। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে হতদারিদ্র্যের হার ‘শূন্যে’ (৩ শতাংশের নিচে নেমে এলেই তাকে শূন?্য ধরা হবে) নামিয়ে আনার যে লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে, তা অর্জন করতে হলে বাংলাদেশকে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে বলে বিশ্ব ব?্যাংকের অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন জানিয়েছেন। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অবশ?্য আশা করছেন, ২০২৪ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ এসডিজির এ লক্ষ?্য অর্জন করবে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৪৬৬ ডলার। বর্তমানে মাথাপিছু গড় আয় হয়েছে ১ হাজার ১৯০ ডলার। বর্তমানে প্রতিবছর দেশের একজন নাগরিকের আয়ের পরিমাণ (১ ডলার সমান ৮২ টাকা ধরে) ১ লাখ ২০ হাজার ১৩০ টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৩১৪ ডলার। এক অর্থবছরের ব্যবধানে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৫১ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় বছরের ব্যবধানে প্রায় ১২ হাজার টাকা বেড়েছে। এর আগে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ১৯০ ডলার। এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, মানবসম্পদ সূচকে কমপেক্ষ ৬৬ স্কোর অর্জন করতে হয়। এ সূচকে বাংলাদেশের বর্তমান স্কোর ৬৩ দশমিক ৮। মাথাপিছু আয় বাড়ানো ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জনের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ সঠিক পথে আছে। জাতিসংঘের নিজস্ব হিসাবে বাংলাদেশের মাথাপিছু গড় আয় ১ হাজার ১৯০ ডলার। এলডিসি থেকে বের হতে এ আয়সীমা ১ হাজার ২৪২ ডলার ছাড়িয়ে যেতে হবে। আর অর্থনীতির ভঙ্গুর অবস্থা মোকাবেলার সূচকে স্কোর ৩২-এর বেশি হওয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বর্তমান স্কোর ২৫, যা ইতিবাচক। মন্ত্রী বলেন, এসব সূচকে বর্তমানে বাংলাদেশের যে অবস্থান তাতে পেছানোর সুযোগ নেই। বরং আরও ভালো করতে হবে। এটি করতে পারলে ২০২১ সালের মধ্যেই আমরা এলডিসি থেকে বের হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারব। দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর প্রথম এক-দুই বছরের দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগে ভাটা পড়েছিল দেশে। কিন্তু সদ্য সমাফত বছরে দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ ফিরে আসায় বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহেও গতি দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গেল বছরের অক্টোবর শেষে বেসরকারি খাতে বিতরণ করা ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৮৫ হাজার ৮০ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৫ দশমিক ২০ শতাংশ বেশি। ২০১৪ সালের অক্টোবর থেকে গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত এ খাতে ঋণ বেড়েছিল ১৩ দশমিক ২২ শতাংশ। এছাড়া গেল অর্থবছরের পুরো সময়ে এ খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এ সময়ে শিল্প স্থাপনের মেয়াদি ঋণ বিতরণের প্রবৃদ্ধিও ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। দেশের পণ্য রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক আছে। তার মানে রফতানি আয় বাড়ছে। সে জন্য প্রবাসী আয়ে মন্দাভাব থাকলেও বৈদেশিক মুদ্রা আয় নিয়ে হাঁস-ফাঁস তৈরি হয়নি। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) পণ্য রফতানিতে ১ হাজার ৩৬৯ কোটি মার্কিন ডলার আয় হয়। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ের ১ হাজার ২৮৮ কোটি ডলারের রফতানির চেয়ে ৬ দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি। গত জুলাই বাদ দিলে বাকি চার মাসে পণ্য রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক। জাতিসংঘ সংস্থা এসকাপের এশিয়া প্যাসিফিক ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১০ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর রফতানি আয়ে গড় প্রবৃদ্ধি ছিল সাড়ে ৭ শতাংশ। তবে বাংলাদেশের বেলায় এ প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ শতাংশ। পোশাক রফতানি বাড়ার কারণেই এমনটা সম্ভব হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। পোশাকের ওপর ভর করেই চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁঁচ মাসের পণ্য রফতানি আয় সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে। আলোচ্য সময়ে মোট রফতানি আয়ের ৮১ শতাংশ বা ১ হাজার ১১৩ কোটি ডলার এসেছে পোশাক রফতানি থেকে। চলতি অর্থবছর পোশাক খাতে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৩৮ কোটি ডলার। আগামী ২০২১ সালের মধ্যে তৈরি পোশাক রফতানি আয় ৫ হাজার কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে বিজিএমইএ। সেটি অর্জন করতে হলে বছরে ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি করতে হবে। গত নভেম্বর মাসে পণ্য রফতানিতে ২৮৯ কোটি ৯৩ লাখ ডলারের আয় হয়। এটি গত নভেম্বরের চেয়ে ৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসের মধ্যে গত মাসেই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রফতানি হয়। আগস্টে হয়েছিল সর্বোচ্চ ৩৩০ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি। দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংক ঋণের সুদহার ‘সিঙ্গেল ডিজিটে’ নামিয়ে আনার দাবিতে ব্যবসায়ীরা আন্দোলন করে যাচ্ছে। বর্তমানে সেটি শিথিল হচ্ছে। বিদেশি ঋণ সহজলভ্য হওয়ায় ব্যাংকগুলো সুদহার কমাতে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, অক্টোবর শেষে ঋণ ও আমানত উভয় ক্ষেত্রেই সুদহার কমিয়েছে ব্যাংকগুলো। তবে আমানতের চেয়ে ঋণের সুদ তুলনামূলক কম কমেছে। এ সময়ে দেশের ৫৬টি ব্যাংকের ঋণের গড় সুদহার দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। যা আগের মাসে ছিল ১০ দশমিক ১৫ শতাংশ। এ সময়ে আমানতের গড় সুদহার দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ। যা আগের মাসে ছিল ৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ। আমানতের পাশাপাশি ঋণের সুদ কমায় নভেম্বরে গড় স্প্রেড কমে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৫৫ পয়েন্টে। অক্টোবরে গড় ৪ দশমিক ৭ শতাংশীয় পয়েন্ট। যা আগস্টে ছিল ৪ দশমিক ৭৬ শতাংশীয় পয়েন্ট। তবে এ সময়ে ব্যাংকিং খাতে গড় স্প্রেড ৫ শতাংশের নিচে অবস্থান করলেও বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলোর গড় স্প্রেড এখনও ৬ শতাংশীয় পয়েন্টের ওপরে রয়েছে। বিদায়ী বছরের পুরো সময়জুড়ে আলোচনায় ছিল রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ও রাজস্ব আদায়ে বিষয়টি। গত জুন মাস পর্যন্ত কিংবা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে নতুন রেকর্ড গড়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। যা বছরের মাঝামাঝি সময়ে বেশ আলোচিত ছিল। যেখানে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি ছিল ১৪ হাজার ৪৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা। সেখান থেকে অর্থবছর শেষে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪ হাজার ৭৮৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা বেশি রাজস্ব আদায় করে বেশ চমক সৃষ্টি করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। যদিও এর আগের ২০১৪-১৫ অর্থবছরেও প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছিল। বিগত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জিডিপির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৭৩ হাজার ২৮৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। বিবিএসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৫টি খাতের মধ্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কম অর্জিত হয়েছে। তবে কৃষি খাতে জিডিপি অর্জন ভালো হয়েছে ৫ দশমিক ১২ শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি জিডিপি অর্জিত হয়েছে শিল্প খাতে ১৪ দশমিক ৪২ শতাংশ। অন্যদিকে হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট খাতে ৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ অর্জন হয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষা খাতে ১১ দশমিক ৭১ শতাংশ, স্বাস্থ্য খাতে ৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ, প্রশাসন খাতে ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশ জিডিপি অর্জন সম্ভব হয়েছে। বর্তমান অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স ও পোশাক শিল্পের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনে বিপুল সাফল্য এবং উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিপুল অভ্যন্তরীণ বহুমুখী বাজার চাহিদা ইত্যাদি অনুকূল উপাদানগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতির পুরনো দরিদ্র অভিধাকে বদলে দিয়েছে। এসব কিছু দেখে বিশ্ব অর্থনীতির চালকরা বাংলাদেশকে বর্তমানে এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির একটি উদাহরণ হিসেবে গণ্য করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের সস্তা শ্রমশক্তি অবাধ বিনিয়োগের সুযোগ আর সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এসব মিলে বিশ্বায়নের যুগে বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে চলছে তাতে মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছানো সময়ের ব্যাপার মাত্র। বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কে নতুন যুগের সূচনার সৃষ্টি করেছে বর্তমান সরকার। অক্টোবরে দুদিনের সফরে বাংলাদেশে আসেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। সফরকালে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়ন, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ, সমুদ্রসীমা রক্ষায় ঢাকা-বেইজিং একযোগে কাজ করার প্রত্যয় করেছেন শি জিনপিং। তার এই সফরকে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কে নতুন যুগের সূচনা বলে অভিহিত করেছেন অর্থনীতিবিদরা। এ সময় ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এছাড়া বিদায়ী বছরে দারিদ্র্য বিমোচন ও এমডিজি অর্জনে বাংলাদেশের সাফল্য দেখতে ঢাকায় আসেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম। তিনি দরিদ্রতা দূরীকরণে বাংলাদেশ সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং জবাবদিহিতার প্রশংসা করেন। পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন চলছে। এর মাধ্যমে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা বাড়ার বিষয়টিও প্রমাণিত হয়। বেড়েছে পুঁজিবাজারে লেনদেনের পরিমাণ, কমেছে অস্থিরতাও। এছাড়া বছরজুড়েই আলোচনায় ছিল বাংলাদেশের বিনিয়োগ বাড়ার সংবাদও। ওষুধশিল্প বাংলাদেশে একটি উদীয়মান শিল্প খাত হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ এখন আর ওষুধ আমদানিকারক দেশ নয়, রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। দেশের উত্পাদিত ওষুধ ইতোমধ্যে বিশ্বের ১৩৩টি দেশে রফতানি হচ্ছে। মেধাস্বত্ব আইন থেকে বাংলাদেশের ওষুধশিল্প আরও ১৭ বছরের জন্য অব্যাহতি পেয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জেনেরিক ওষুধ উত্পাদনের জন্য মেধাস্বত্ব আইন প্রযোজ্য হবে না। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য এ সুবিধাটি দিয়েছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)। এই খাতের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। বর্তমানে দেশের ওষুধশিল্প খাতে প্রায় নয় হাজার কোটি টাকার ওষুধ উত্পাদিত হচ্ছে। এ উত্পাদন থেকে অভ্যন্তরীণ চাহিদার শতকরা ৯৭ ভাগ মেটানো সম্ভব হচ্ছে। অথচ একসময় বিদেশি কোম্পানিগুলো এ দেশের ওষুধের বাজারের ৭৫ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করত। এই খাতের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। |