বৃত্তের বাদামি খামে চিঠি আসছে তোমার নামে
Published : Tuesday, 27 September, 2022 at 5:25 PM, Update: 27.09.2022 5:28:41 PM, Count : 2586

তারিন সুমাইয়া, কুবি প্রতিনিধি:
করুণা করে হলেও চিঠি দিও, ভুলে গিয়ে ভুল করে
একখানি চিঠি দিও খামে
কিছুই লেখার নেই তবু লিখো একটি পাখির শিস
একটি ফুলের ছোট নাম..
করুণা করে হলেও চিঠি দিও,
খামে ভরে তুলে দিও আঙ্গুলের মিহিন সেলাই
                                                                   ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও,
                                                             এটুকু সামান্য দাবি, চিঠি দিও। --মহাদেব সাহা

একটা খামেপুরা চিঠির সুপ্ত অপেক্ষায় কৈশোর থেকে যৌবনের কতো মুহুর্ত কেটে যায়, কিন্তু কখনো বলা হয়ে উঠে না, “চিঠি দিও, প্রিয়”। কনফেশন পোস্ট আর ফেইসবুকীয় ভাবাবেগের যুগে হাতে লিখা চিঠি আজ সময়ের পরিক্রমায় ‘ব্যাতিক্রম আর অভিনব’ মাধ্যমই হয়ে গেছে। মনের কোনে জমা শুভ্র মিষ্টি অথবা চাপা বিষাদময় অনুভুতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অক্ষরে কালো কালিতে পুরে প্রিয়জনের কাছে পৌছে দেওয়া আজ অতীত হয়েছে। ফেইসবুকের কনফেশন পাতায় কনফেশন আসে, লুকিয়ে রাখা অনুভূতি নীল স্ক্রীনে পৌছে যায়। কিন্তু কোথায় যেন আবেগের গভীরতা নেই, অকপট অনুভূতির অকৃত্রিমতা নেই। হুট করে বেনামে বা সংকোচভরা হাতে লাজুক অক্ষরে লিখা ইতিতে চিঠি পেয়ে কাগজখানা বুকের কাছে নিয়ে অনুভব করার গেছে যে দিন তা কি একেবারেই কি গেছে..?

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র গ্রাফিতিভিত্তিক সংগঠন ‘বৃত্ত কুবি’ চিঠির এই আবেগকে ফিরিয়ে আনতে অভিনব এক উদ্যোগ নিয়েছে। লালমাটির ক্যাম্পাসের এক কোনে পরিত্যক্ত দেয়ালে দাড় করিয়েছে চিঠিকে উৎসর্গ করেই এক চত্বর। ডাকবাক্স আছে সে দেয়ালে, আছে চিঠি পৌছে দেওয়ার এক উদ্যমী দল। আর বৃত্তের কাজই যেহেতু রঙ নিয়ে তাই ডাকবক্সের আসনটুকুও রাঙিয়েছে তারা চমৎকার দেয়ালচিত্রে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাফিতি অঙ্কনের সংগঠন বৃত্ত’র লক্ষ্যই ক্যাম্পাসের ধুলো ময়লা জমা দেয়ালগুলোতে রঙ তুলির আঁচড়ে প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের মলিন দেয়ালগুলোই তাদের আঁকার ক্যানভাস। রঙ তুলির আঁচড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নানান দেওয়াল এখন বলে দারুণ সব কথা। ব্যাতিক্রম নয় এবারের চত্বরও। চত্বরের ডাকবাক্সের দেয়ালটি সেজেছে লাল-হলুদ-নীল গ্রাফিতিতে আর আশেপাশের পরিবেশও সেজেছে তুলির ছোয়ায় নতুন করে।

বৃত্ত কুবির সহ-প্রতিষ্ঠাতা আরাফাত রাফি বলেন, “সেই ছোটবেলা থেকেই একটি গান শুনে আসছি, ‘ভালো আছি, ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো।’ আসলে আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখতে লিখতে মানুষ অনেক ক্লান্ত। মানুষের এই ক্লান্তি দূর করার জন্যই আমাদের এ উদ্যোগ। যেখানে হচ্ছে মানুষ আকাশের ঠিকানায় চিঠি না লিখে সরাসরি আমাদের চিঠি চত্বরের পোস্ট বক্সে চিঠি জমা দিতে পারবে। কারো জন্য হুট করেই চিঠি আসবে, সে জানবে না কি আছে চিঠিতে। চিঠি পাওয়ার এইযে আনএক্সপেক্টেড আনন্দ, চিঠি পড়ার যে ব্যাকুলতা, এই ব্যাপারটা ফিরে আসুক আবার আমাদের মাঝে এইটুকুই চাওয়া।- চিঠি চত্বর নিয়ে এমন আশার কথা বলছিলেন বৃত্তের হেড অব কমিউনিকেশন কানিজ ফাতেমা সুমি।

এ শতাব্দীতে এসেও হারিয়ে যাওয়া চিঠির যে আবহ তা নতুন করে ফিরিয়ে আনতেই ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে চিঠি চালাচালির অভিনব এ উদ্যোগের শুরু বৃত্তের। নিজস্ব মৌলিক কাজগুলো বৃত্ত এখন পর্যন্ত নিজ অর্থায়নেই করেছে। তবে এবার কুমিল্লা ডাক বিভাগে এ আইডিয়া নিয়ে পৌছালে ডাক বিভাগও দিয়েছে স্বতস্ফূর্ত সাড়া, উপহার পাঠিয়েছে একটি ডাকবিভাগের লগো সম্বলিত ডাকবাক্স। হলুদ রঙের মাঝে নীল দিয়ে ফুটিয়ে তোলা চিঠি চত্বর, পাশে সবুজ দেয়ালে ডাকবাক্স বসানো। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক বিল্ডিংগুলোর দিকে যাওয়ার রাস্তা বাঁ-পাশেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাডমিন্টন কোর্টের কূল ঘেঁষে এ চত্বরের অবস্থান। ফ্যাকাল্টির পথে হেটে যাওয়ার রাস্তায় পাশ থেকে চিঠি চত্বর দিচ্ছে চিঠির আহবান। ২৭ সেপ্টেম্বর এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের উপস্তিতিতে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মধ্য দিয়েই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হবে চিঠির নতুন অব্দ। সেই সঙ্গে ঐদিন সাংগঠনিকভাবে যাত্রা শুরু করছে বৃত্ত কুবি।

ক্যাম্পাসের সব অনাদরে পড়ে থাকা জায়গাগুলো সাজিয়ে নতুন প্রাণ দেওয়াই মূল উদ্দেশ্য বৃত্তের। এবারও এতোদিন ধরে ব্যাডমিন্টন কোর্টের পাশে পড়ে থাকা দৃশ্যত ময়লার স্তুপের জায়গাটিকেই রাঙিয়ে নতুন রুপ দিয়েছে তারা। যেখানে আগে কেউ পা মাড়াতো না সেখানে আজ লাল, হলুদ, নীল, সবুজ নানা রঙে রঙ্গিন চত্বরটি ঘিরে চলছে ছবি তোলার হিড়িক। উদ্বোধনের আগেই ভীর করছে উৎসুক শিক্ষার্থীসহ দর্শনার্থীরা। হবেই বা না কেন? এর আগে এমন এক ব্যাতিক্রম ভাবনার উদ্যোগ এই প্রথমই। চিঠি নিয়ে এমন ভাবনা আর তাকে উৎসর্গ করে খোদ এক চত্বরের উদাহরণ নেই অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে।

একটা সময় ছিলো যখন যখন যোগাযোগের মূল মাধ্যমই ছিলো চিঠি। কথার আবেদন চিরকালই থাকছে, তবে আজকের সেই চিঠি কে মোটামোটি প্রত্নতাত্বিক বিষয়ই বলা যেতে পারে। আধুনিক প্রযুক্তির যুগে এসে তা ফেইসবুক- হোয়াটসঅ্যাপ- ইমো- ভাইবারের নিচে চাপা পড়ে গেছে। নতুন প্রজš§তো জানেই না একসময় মানুষ হাতে চিঠি লিখত। বিশেষ করে জেনারেশন জি’র ভাগ্যে সরাসরি চিঠি লিখার বা পাওয়ার অভিজ্ঞতা তো হয়ইনি, সক্রিয় ডাকবক্সও দেখেনি। চিঠিবাক্স খুলে চিঠি নেওয়া বা পিয়নের হাতে চিঠি পাওয়া সবই কেবল একটা ধারণা। তবে সবাই-ই হয়তো কখনো না কখনো বাড়ির পুরনো জিনিস ঘাটতে গিয়ে খুজে পেয়েছি দাদার আমলে লিখা চিঠি, অথবা মা-বাবার লিখা প্রেমপত্র হাতে পেয়ে মুচকি হাসি হেসেছি। কিন্তু একটা দীর্ঘশ্বাস রয়ে গিয়েছিলো কোথাও না কোথাও, ওমন অমলিন প্রেমের আদান-প্রদান না পাওয়ার আক্ষেপে। আবার কি মানুষ কখনো হাতের লেখা চিঠিতে ফিরে যাবে! সময়ের বিবর্তনে আজ বৃদ্ধ অস্তিসার কঙ্কাল রূপে দাড়িয়ে আছে ডাকঘরের পোষ্ট বক্স গুলো। তাই বলে, চমৎকার বাক্য প্রয়োগের মাধ্যমে অন্যকে মুগ্ধ করার ইচ্ছা প্রজš§ থেকে প্রজšে§ থেমে থাকে? কখনো কি কোনো গুমোট দুপুরে রবীন্দ নাথের ছিন্নপত্র পড়তে যেয়ে ডাকপিয়নের হাতে চিঠি এসে পৌছাবে এমন আশা জাগেনি! টুকিটাকি হয়তো হারিয়ে গেছে কিছু, হয়তো পাওয়া হয়নি সেই চিঠির যুগ- তবুও চুপচাপ কোন দুপুরবেলায় কখানা চিঠি পাব একদিন, কোন এক অপরিচিত ঠিকানা থেকে চিঠি আসবে কোনো এক গুনমুগ্ধ প্রেমিকের.. চিঠিতে থাকবে মিষ্টিবাক্যের স্তব। আর সে চিঠি পেয়ে অমল মন ভরে উঠবে। অথবা চিঠি আসবে প্রিয়জন, বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে, তাতে লুকিযে থাকবে মানুষের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ,আবেগ আর ভালোবাসা Í এমন শখ কতোর মাঝেই চাপা আছে। আজো তো কেউ চিঠি চায়, পথ চেয়ে থাকে। কিন্তু অভাব শুধু ডাকবাক্সের আর সুযোগের। এবার আসবে বৃত্তের চিঠিবাহক, ডাকবাক্সে চিঠি দিলে বাড়ি পৌঁছে দেবে তাদের হাতে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাসমিয়া মাহমুদ বলেন, “ডিজিটাল কমিউনেকেশনের যুগে আগের দিনে চিঠির যে চালাচালি হতো তা আবার নতুন করে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে আমাদের ক্যাম্পাসে তা আসলেই প্রশংসার যোগ্য। চিঠি চত্বরের কাজটার জন্য বৃত্তকে অবশ্যই সবসময় সমর্থন জানাচ্ছি এতো সুন্দর একটি ভাবনা তুলে ধরার জন্য। ক্যাম্পাসের অন্য আরো অনেক চত্বরের মতো সময়ের কালে এ চত্বরটিও যাতে হারিয়ে না যায় এমনি কামনা শিক্ষার্থীদের। এ চত্বরের মাধ্যমে চিঠির চর্চা আর ঐতিহ্য ৫০ একরে ফিরিয়ে আনতে আশাবাদী কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চিত্রশিল্প বিষয়ক সংগঠনটি। ডাকবাক্স আছে, গ্রাফিতি আছে, চিঠি পৌঁছে দেওয়ার জন্য বৃত্ত আছে। সকলে তার প্রিয় শিক্ষক, প্রিয় বন্ধু, প্রিয় মানুষ, প্রিয় জুনিয়র কিংবা সিনিয়র। থাকবে তাতে আনন্দের হাতছানি অথবা একান্ত বিষাদকথন। আর তা প্রাপকের কাছে সযত্নে পৌছে দিবে বৃত্ত কুবি। নামসহ চিঠি, বেনামী চিঠির পাশাপাশি লিখার সুযোগ রয়েছে খোলা চিঠির। হতে পারে তা কুবির নীল বাসকে উদ্দেশ্য করে খোলা চিঠি, অথবা প্রিয় কাঁঠালতলাকে নিয়েই! অথবা যোগাযোগবিহীন ব্যক্তিকে উদ্দেশ্যে করে লিখা চিঠিই। প্রেরকের পাঠানো খামেভরা চিঠি বৃত্ত তাদের চত্বরের সিল সম্বলিত মোড়কে করে প্রাপকের কাছে পৌঁছে দিবে। তবে তা অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ হতে হবে। খোলা চিঠিগুলো প্রকাশিত হবে বৃত্তের অনলাইন পেইজেই।

 
রুদ্রের ব্যাকুল আকাঙ্খার মতোন আকাশের ঠিকানায় লিখতে চাওয়া চিঠিগুলো আকাশের ঠিকানাতেই নাহয় লিখা হোক, থাকুক প্রাপকের অপার ঠিকানায়। আর কথা থাকুক বৃত্তের লাল ডাকবাক্সে সেসব আবেগ আর চিঠিটুকুন প্রযত্নে জায়গা খুঁজে পাবার। খোলা জানলার ফাকে চিঠির আবেগ আর না পাঠানো কথাগুলো যাতে হারিয়ে না যায়, সেই প্রতিশ্রুতিতেই বৃত্তের এই চিঠি চত্বর যাতে স্বার্থক হয়। রুদ্রের মৃত্যুর পর “ প্রিয় রুদ্র, প্রযত্নে আকাশ’ সম্ভাষনে তসলিমা নাসরিনের লিখা বিখ্যাত সেই চিঠিটির শেষে মিষ্টি করে তসলিমা লিখে দিয়েছিলেন “ইতি সকাল”। তেমনি শত শত প্রিয় আর ইতিতে ভরে উঠুক কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ বৃত্তের এ লাল ডাকবাক্স। এ চিঠি চত্বরের মধ্য দিয়ে চিঠির পুরনো সেই আবেগটা ফিরে আসুক সবার মাঝে।



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : [email protected], [email protected]
Developed & Maintainance by i2soft