বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ: মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা একই সূত্রে গাঁথা
Published : Saturday, 3 March, 2018 at 9:02 PM, Count : 4910

মোতাহার হোসেন : জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে ঐতিহাসিক রমনা রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার উত্তাল জনসমুদ্রে প্রদত্ত ভাষণ। অতি সম্প্রতি জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ভাষণ নিয়ে গবেষণা চলছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয় এই ভাষণ। তাছাড়া বিশ্বের বিখ্যাত রাজনীতিকদের যে কয়টি ভাষণ খ্যাতি পেয়েছে তার মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ স্বীকৃতি পেয়েছে। এতো কিছু সত্ত্বেও স্বাধীনতা অর্জনের সুদীর্ঘ বছরেও স্বাধীনতার ঘোষণা, স্বাধীনতার ঘোষক প্রভৃতি নিয়ে রাজনৈতিক মাঠে অবাঞ্চিত, অনাবশ্যক বিতর্ক চলে আসছে। এটা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জার। তবুও প্রত্যাশা থাকবে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ‘বিশ্বঐহিত্য’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কের অবসান ঘটবে।
এটি চির সত্য যে, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে সুষ্পষ্টভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। একই সাথে বাঙালিকে ‘যার যা কিছু আছে-তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা’ করার আহ্বান জানান তিনি। তার এই ভাষণে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জাতিকে স্বাধীনতার জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ারও আহ্বান জানান তিনি। মূলত সেদিন থেকেই দেশের অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য, কলকারখানা সবকিছু চলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই। বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী এ ভাষণকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। বঙ্গবন্ধু সেই ভাষণে আরও বলেন, ‘২৫ মার্চ তারিখে ইয়াহিয়া খান অ্যাসেম্বলি কল করেছেন। রক্তের দাগ শুকায় নাই... শহীদের রক্তের উপর পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। অ্যাসেম্বলি কল করেছেন। আমার দাবি মানতে হবে। প্রথমে সামরিক আইন (মার্শাল ল’) উইথড্র করতে হবে। সকল সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবো অ্যাসেম্বলিতে বসতে আমরা পারবো কি পারবো না।’
তার প্রতি দেশের মানুষের আস্থা-বিশ্বাস আছে কি-না বঙ্গবন্ধু সে কথা জানতে চাইলে মুক্তিকামী লাখো জনতা হাত উঠিয়ে আস্থা জ্ঞাপন করে। বঙ্গবন্ধু দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, দেশের মানুষের অধিকার চাই।’ পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনের ভার স্বহস্তে গ্রহণ করে পাকিস্তান সরকারের প্রতি অসহযোগিতার আহ্বান জ্ঞাপন করে বঙ্গবন্ধু দ্ব্যর্থকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাছারি, আদালত, ফৌজদারি আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। কোনো কর্মচারী অফিসে যাবেন না। এ আমার নির্দেশ। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সে জন্য যে সকল অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না।... ২৮ তারিখে কর্মচারীরা বেতন নিয়ে আসবেন। ’
বঙ্গবন্ধুর ঐ নির্দেশ অমান্য করলে পাকিস্তান সরকার এরপরও বাঙালির আত্মপ্রতিষ্ঠার দাবির বিরোধিতা করতে থাকলে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধু উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘এরপরে যদি বেতন দেয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা আছে, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।’ সরকারি কর্মচারীদের প্রতি নির্দেশ দান করে তিনি বলেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার দেশের মুক্তি না হয়- খাজনা, ট্যাক্স বন্ধ করে দেয়া হলো।’ তিনি বলেন, ঐক্যে বিজয়, বিভেদে পরাজয়। হিন্দু, মুসলমান, বিহারী, বাঙালির মধ্যে বিরোধ সৃষ্টির অপচেষ্টা সম্পর্কে তাই সতর্ক থাকার জন্য বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘... শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, মিছিলের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলার হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি, নন-বাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে। আমাদের যেন বদনাম না হয়।... যদি এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝে-শুনে কাজ করবেন।’ বাঙালি জাতিকে সকল দিক থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধুর এই নির্দেশ তাত্পর্যপূর্ণ।
মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু করার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন- ‘প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব- এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান জ্ঞাপনের জন্য ৭ মার্চের ভাষণকে ‘ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্স’ হিসেবে অভিহিত করা যুক্তিযুক্ত। সেদিন সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার চূড়ান্ত মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল। ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রত্যশাকেই মূর্ত করেছেন ৭ মার্চের ভাষণে।
প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ঐতিহাসিক তাত্পর্যে মণ্ডিত। আব্রাহাম লিঙ্কনের গেটিসবার্গ অ্যাড্রেসের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের তুলনা করা হয়। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ (অলিখিত এবং স্বল্প সময়ের) বিশ্বের অন্যতম সেরা ভাষণ। এর আগে আব্রাহাম লিঙ্কনের গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস বিশ্বের সেরা ভাষণ হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। তার ঐ ভাষণের সারমর্ম ছিল- জনকল্যাণ করতে পারে ‘জনগণের, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য সরকার, যা পৃথিবী থেকে ধ্বংস হবেই না।’ অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের জনসভায় প্রদত্ত ভাষণের বিষয়বস্তু আরও অনেক বেশি ব্যাপক, বিস্তৃত, অর্থবহ। মুক্তিযুদ্ধের রণকৌশল, স্বাধীনতা আদায় ও রক্ষা এবং জনগণকে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তাসহ কূপমুণ্ডকতা থেকে মুক্ত করার দিক-নির্দেশনা। পাশাপাশি সুদূরপ্রসারী অঙ্গীকার। কাব্যিক ও শ্রুতিমধুর, প্রাঞ্জল, সাবলীলভাবে প্রকাশ্যে স্বাধীনতা ঘোষণার দ্বিতীয় নজির পৃথির আর কোনো স্বাধীনতাকামী, মুিক্তকামী নেতার মুখে উচ্চারিত হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধিক জনপ্রিয় পত্রিকা নিউজ উইক পত্রিকার ৭ এপ্রিল ’৭১ সংখ্যায় এ ভাষণের জন্য বঙ্গবন্ধুকে চড়বঃ ড়ভ ঢ়ড়ষরঃরপং বা ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের ১০ মার্চের প্রস্তাবিত বৈঠক প্রত্যাখ্যান করেন, সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা অর্পণের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন। প্রকৃতপক্ষে ৭ মার্চ থেকে কেন্দ্রীয় শাসনের প্রভাবমুক্ত ও কর্তৃত্বমুক্ত থেকে পূর্ববাংলা স্বাধীন সত্তা অর্জন করে এবং সকল কর্তৃত্বের অধিকারী হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হন বাংলার মুকুটহীন রাজা। সে সময়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানা যাবে পাকিস্তানী জেনারেল রাও ফরমান আলী খানের একটি বর্ণনা থেকে। ‘বাংলাদেশের জন্ম’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন: ‘৭ মার্চ প্রদেশের সিনিয়র অফিসাররা যখন নতুন এমএলএ (সামরিক আইন প্রশাসক) জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাত্ করলেন, তখন তাদের মনোভাব ছিল উদাসীনের মতো। এটা সুস্পষ্ট ছিল যে, একই উদ্দেশ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে তাদের হূদয়ও চলমান আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল। এসবের ফলে ইডেন বিল্ডিং-এর পরিবর্তে প্রাদেশিক সচিবালয়ের কাজকর্ম চলছিল শেখ মুজিবের বাসভবন থেকে। রেডিও, টেলিভিশন, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ ও রেলওয়েসহ সকল সরকারি বিভাগই আওয়ামী লীগ হাইকমাণ্ডের নির্দেশাবলী পালন করছিল।... অসামরিক প্রশাসনের সহযোগিতা ব্যতীত মার্শাল ল’ কর্তৃপক্ষের পক্ষে কাজকর্ম চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছিল, বিশেষ করে এমন একটি পরিস্থিতিতে যখন প্রদেশের সমগ্র জনগণের মনোভাবই ছিল অমান্য করার।’
আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের প্রদত্ত ভাষণ নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য সূচিতে অন্তর্ভুক্তির। একই সাথে জনসমক্ষে এই ভাষণ বেশি বেশি বাজানো, প্রচার করা। একটি কথা চির সত্য যে, শুধু বাংলাদেশ, বাঙালি নয়, বিশ্বের মুক্তিকামী, অধিকার বঞ্চিত, স্বাধীনতাকামী জনগণের জন্য এই ভাষণ, অনুপ্রেরণা এবং দিক-নির্দেশনা যোগাবেন। তাই দেশের, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ আর এই ভাণষ একই সূত্রে গাঁথা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। 



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : [email protected], [email protected]
Developed & Maintainance by i2soft