অপরিকল্পিত নগরায়ন প্রসঙ্গে
Published : Friday, 5 January, 2018 at 8:52 PM, Count : 14136

রায়হান আহমেদ তপাদার : ঢাকা শহরে অনেক সঙ্কটের মূলে রয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ন। যার ফলে তিল পরিমাণ স্থান খুঁজে পাওয়া হয়ে পড়েছে দুষ্কর। বাসস্থানের অভাবে যত্রতত্র গড়ে উঠছে বস্তি। যেখানে মানবেতর অবস্থায় ভাসমান মানুষের বসবাস। যার ফলশ্রুতিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সৃষ্টিরও অন্যতম কারণ। 
রাস্তায় বের হলে চোখে পড়ে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। খোলা আবর্জনার দুর্গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে পুরো শহরময়। এই শহরে এ যেন নিত্যদিনের সঙ্গি নগরবাসীর কাছে। এদিকে শহরের বিপুল জনসংখ্যার বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে গিয়ে অবৈধ দখলদারিত্ব বেড়ে চলেছে আশঙ্কাজনক হারে। লেক ও নদীর পাড়গুলো দখল করে নিচ্ছে কিছু অসাধু লোক। যার ফলে মরে যাচ্ছে নদী, লেক-জলাশায় হচ্ছে দূষিত। যার ফলে ঢাকা শহরে জলাবদ্ধতার মতো সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। খুব সহজ সমীকরণে বলা যায় জনসংখ্যা যত বেশি হবে তাদের দ্বারা সৃষ্ট বর্জ্যও তত বেশি হবে। এসব বর্জ্য যত্র তত্র নিক্ষেপের ফলে সৃষ্টি হয় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। পাশাপাশি শহরের পরিবেশ দূষণও মারত্মক আকার ধারণ করে। লেক, জলাশায় ও নদীতে ময়লা আবর্জনা ছুড়ে ফেলার ফলে পানি হচ্ছে দূষিত। এতে সৃষ্টি হচ্ছে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগের। যা ছড়িয়ে পড়ছে মানবদেহে। বিশেষ করে লক্ষ্যণীয়, শহরের বস্তি এলাক গুলোতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সবচাইতে বেশি পরিলক্ষিত হয়। এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বিভিন্ন জীবাণু থাকে যা আশেপাশের পরিবেশকে সংক্রামিত করে। ফলে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। 
আমাদের চারপাশ নিয়েই আমাদের পরিবেশ। এই পরিবেশের মাটি, পানি, বায়ু ও শব্দ দূষণের সঙ্গে আমরা খুবই পরিচিত। বিভিন্ন সংগঠন এসব দূষণ নিয়ে মতবিনিময় থেকে শুরু করে সচেতনতামূলক কাজ করে যাচ্ছে, যা সত্যি প্রশংসার দাবিদার। এতে সামান্য হলেও কিছুটা সচেতনতা মানুষের ভেতর সৃষ্টি হচ্ছে আমার বিশ্বাস। 
ঢাকা আমাদের রাজধানী। হয়তো রাজধানী নিজেই হাহাকার করছে তার নিজের সৌন্দর্য হারিয়ে যাচ্ছে বলে। গবেষণায় দেখা গেছে, দৃষ্টিনন্দন রঙ যেমন নীল, সবুজ, গোলাপী, সাদা বেগুনী, ধূসর, হলুদ চোখে আরাম প্রদান করে। বিলবোর্ড পোস্টার বৈদ্যুতিক তার, ইত্যাদি কোথায় স্থাপিত হবে তার জন্য সুপরিকল্পিত নগরায়ন পরিকল্পনা করা দরকার। পণ্য বিক্রয় বিজ্ঞাপনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশের কথা মনে করিয়ে দিবে। সামান্য বৃষ্টির কারণে জলবদ্ধতায় সাধারণ জনগণের, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের চলাচল কষ্টকর ও অনিরাপদ হয়ে উঠলে তাকে বাসযোগ্য নগর বলা যায় না। 
এক গবেষণায় বলা হয়, ‘শতকরা ৩৪ শতাংশ মানুষ নগরে বসবাস করে। অথচ গত ২০/২৫ বছরে নগরায়ন পরিকল্পিতভাবে হয়নি। যেখানে সেখানে ঘর-বাড়ি উঠে যাচ্ছে। সমস্যায় জর্জরিত আবর্জনা ব্যবস্থাপনা। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শহরে মাইগ্রেশন বাড়ছে। একইসঙ্গে শহরে সুপেয় পানির ওপর প্রভাব পড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে সঠিক পরিকল্পনা মাফিক কাজ না হলে শহর ব্যবস্থাপনা আমাদের জন্য কঠিন হবে। তাই সমস্যা সমাধানে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে আগাতে হবে।
এ কথা বলা যায় যে, আগে জলবায়ুর একটা সীমারেখা ছিল। কিন্তু এখন আর সেটা নেই। যেই সময়ে শীত থাকার কথা সেই সময়ে থাকছে না। আমাদের শহর জলবায়ুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের ধারণাপত্রে বলা হয়, বৈশ্বিক উষ্ণতা ইতোমধ্যে জলবায়ুর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি করেছে, তার প্রভাবে গত দুই দশক ধরে বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষের ওপর জলবায়ু পরিবর্তন জনিত বিপর্যয়ের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কারণে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। 
জলবায়ু পরিবর্তন একটি সমস্যা। তার সঙ্গে যোগ হচ্ছে নগরায়নের বিষয়। এই সমস্যাগুলো সমাধানে সচেতনতা বাড়াতেই হবে। অন্যদিকে অপরিকল্পিতভাবে নগরায়নের থাবা পড়েছে ফসলি জমির ওপর। কমে যাচ্ছে আবাদি বা ফসলি জমি। অনেক শহরে এ অবস্থা আশঙ্কাজনক। দেখা যাচ্চে জমি কমে যাওয়া উত্পাদন কমেছে। যা আমাদের দেশের জন্য মোটেও সুখকর খবর নয়।
কর্মসংস্থান বা নানা কারণে যারা শহরমুখী তাদের বড় একটি অংশই শেষ পর্যন্ত শহরের অধিবাসী হয়ে যান। প্রথমে তারা ভাড়া বাড়িতে থাকেন। তারপর বসতবাড়ি গড়ার জন্য জায়গা কেনেন। একপর্যায়ে বাড়ি নির্মাণ করেন। এর ফলে নগরীতে হালে ডেভেলপারের সংখ্যা বেড়ে গেছে, যারা নগরীর ভেতরে বিভিন্ন পাড়া ও মহল্লা ছাড়াও শহরতলী এলাকা এবং পৌর এলাকার বাইরে জমি কিনে বহুতল ফ্ল্যাট বাড়ি নির্মাণ করছেন। এভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে নগরায়ন প্রক্রিয়া। আর তাই দেশের প্রায় প্রতিটি শহরই এভাবে অপরিকল্পিত নগরায়নের শিকার। 
এভাবে রাজধানী ঢাকাসহ প্রায় প্রতিটি শহরই অপরিকল্পিতভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে। এখনই অনেক শহর বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। তাই নগরকে বাসযোগ্য করতে শহরমুখী জনস্রোত কমানোর পাশাপাশি বিকল্প কর্মপরিকল্পনা নিয়ে ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ গ্রাম পর্যায়ে বৃদ্ধি করে এবং গ্রামীণ অবকাঠামোসহ বসবাসের ক্ষেত্রে সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এ ভাবে নানা পরিকল্পনার মাধ্যমে অপরিকল্পত নগরায়ন ঠেকাতে হবে। এটা না পারলে ভবিষ্যতে বসবাস অনুপোযোগী হবে আরও অনেক শহর। আমরা লক্ষ্য করছি, অধিক জনসংখ্যা ও পর্যাপ্ত জায়গার অভাবে ঢাকায় বিনোদনের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই। কয়েকটি নির্দিষ্ট পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্র ছাড়া তেমন বিশুদ্ধ নির্মল পরিবেশের অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। শিশুদের বিকাশে যে পর্যাপ্ত বিনোদনের ব্যবস্থা থাকা উচিত তার ছিটেফোঁটাও নেই। নেই কোনো খেলার মাঠ। নেই কোনো নির্মল পরিবেশ। গাছ-পালার অভাব ও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। 
আজকাল আবার বিভিন্ন মাঠ দখল করে সুপার মার্কেট, এপার্টমেন্ট ইত্যাদি গড়ে তোলার হিড়িক পরেছে। ফলে শিশুরা খেলার মাঠ থেকে বঞ্চিত। ঘরের কোনায় থাকতে থাকতে তাদের পর্যাপ্ত মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। ঢাকার আরও একটি বড় সমস্যা হলো যানজট। অপরিকল্পিত নগরায়নের আরো একটি উত্কৃষ্ট উদাহরণ। পরিকল্পনার অভাব ও নানা অনিয়মের ফলে শহরের রাস্তাঘাটে হরহামেশাই যানজট লক্ষ্য করা যায়। ফলে পথচারী ও যানবাহনগুলোর অসুবিধা অনেক বেশি হয়। এখানেও পরিকল্পনার অভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। দেশের প্রতিটি বিভাগে যদি সঠিক ও পরিকল্পিত দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় তাহলে হয়তো নির্দিষ্ট কিছু বড় শহরগুলোতে কাজের খোঁজে যাওয়া লোকের সংখ্যা কমে আসত। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশের মধ্যে যে হাজারো পর্বতসম সমস্যা আছে সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। সবাই যেন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন। সবাইকেই সরব হতে হবে। 

লেখক: কলামিস্ট 



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : [email protected], [email protected]
Developed & Maintainance by i2soft